সৎ মায়ের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, নিজের চিরচেনা গ্রাম ছেড়ে দুখু (১২) চলে এসেছিল ঢাকা শহরে, তারপর থেকে শুরু আর এক দুঃখের জীবন। বেঁচে থাকার তাগিদে জড়িয়ে পড়ে চুরি আর মাদকের করাল থাবায়। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম চত্বরসহ রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে দুখুর মত হাজারো মাদকাসক্ত শিশু কিশোরদের হরহামেশাই চোখে পড়ে। আসক্ত এই সবশিশুদের দিয়ে কেউ ভিক্ষা করাচ্ছে আবার কেউ আবার ভাড়ায় মাদকের ব্যবসা করাচ্ছে। মা বাবা, আপনজন থেকে বিচ্ছিন্নভাবে জীবনযাপন করায় সহজেই এই সব পথ শিশুরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। এদের অধিকাংশই মাদকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানে না। আর যে বয়সে এসে জানতে ও বুঝতে শেখে তখন আর তাদের পিছন ফেরার কোন সুযোগ থেকে না। ততদিনে মাদক এই সব পথ শিশুদের জীবন পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলে। পথ শিশুরা তাদের বাবা-মাকে হারানোর কষ্ট ভুলে থাকতে এবং ময়লা-আবর্জনা কুড়ানোর সময় দুর্গন্ধ আর সেই সময়ে হাত পা কেটে গেলে ফুলে ব্যথা অনুভুত হয় তা ভুলে থাকে এ নেশা গ্রহণ করে। এছাড়া যে মহাজনের কাছে তারা জিনিস বিক্রি করে তিনিই এসব নেশা করার কথা জানিয়ে দেন।পথ শিশুরা সাধারণত গাঁজা, হেরোইন, ঘুমের ওষুধ, ডান্ডি ইত্যাদি মাদক জাতীয় দ্রব্য পলিথিনের মধ্যে গামবেলডিং দিয়ে অথবা পেট্রোল শুকে নেশা করে।
অপরাজয়ী বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদ বানু জানান, দেশে বর্তমানে প্রায় ১৪ লাখ পথশিশু রয়েছে, যারা কোনো না কোনোভাবে মাদক সেবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, পথশিশুদের ৮৫ ভাগই কোনো না কোনোভাবে মাদক সেবন করে। এর মধ্যে ১৯ শতাংশ হেরোইন। ৪৪ শতাংশ ধূমপান, ২৮ শতাংশ বিভিন্ন ট্যাবলেট ও আট শতাংশ ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে নেশা করে থাকে।
সংগঠনটির তথ্যানুযায়ী ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি স্পট রয়েছে যেখানে নয় থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা মাদক সেবন করে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ২১টি স্পটে সূঁচের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ, ৭৭টি স্থানে হেরোইন সেবন এবং ১৩১টি স্থানে গাঁজা ও গ্লোসিন সেবন করা হয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট সূত্র মতে, ঢাকা বিভাগে মাদকাসক্ত শিশুর প্রায় ৩০ শতাংশ ছেলে এবং ১৭ শতাংশ মেয়ে। মাদকাসক্ত ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ছেলে এবং মেয়ে শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন জানায়, মাদকাশক্ত ৮০ শতাংশ পথশিশু মাত্র সাত বছরের মধ্যে অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণা জরিপের মাধ্যমে জানা যায়, মাদকাসক্ত শিশুদের ড্রাগ গ্রহণ ও বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত ৪৪ শতাংশ পথশিশু, পিকেটিংয়ে জড়িত ৩৫ শতাংশ, হাইজ্যাকের সঙ্গে ১২ শতাংশ, ট্রাফিকিংয়ে ১১ শতাংশ,আন্ডারগ্রাউন্ড সন্ত্রাসীদের সোর্স হিসেবে পাঁচ শতাংশ ও অন্যান্য অপরাধে জড়িত ২১ শতাংশ, বোমাবাজির সঙ্গে জড়িত ১৬ শতাংশ পথশিশু।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে বলা হয়েছে, শিশুদের নিরাপত্তা ও বেঁচে থাকার অধিকার জন্মগত। সনদের ১৯ ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্র শিশুদের যে কোনো ধরনের অনাচারের কবল থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করবে। যা এসব আসক্ত শিশু-কিশোরের বেলায় অধরা। এক কথায় শৈশব চুরি হচ্ছে মাদকের ব্যবহার ও প্রসারে। মাদকাসক্ত দুর্ভাগা পথ শিশুদের মাদকের কবল থেকে রক্ষার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দৃশ্যত তেমন কোন উদ্যোগ নেয়া হয়না। ৪০ শয্যা বিশিষ্ট সরকারি যে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে তাতে পথ শিশুদের জন্য চিকিৎসার তেমন কোন বিশেষ সুযোগ নেই, এবং তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অপ্রতুল। এমনকি মাদকাসক্ত পথ শিশুদের মাদকের হাত থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের কোন কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম বা সচেতনতা মুলক কার্যক্রম ও খুব একটা দেখা যায় না। বেশ কিছু বেসরকারি এনজিও মাদকাসক্ত পথ শিশুদের নিয়ে কাজ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম এবং তাদের কার্যক্রমও সব সময় ধারাবাহিক থাকছে না। ফলে আমাদের চিরচেনা শহুরে সমাজে আমাদের চারপাশে বেড়ে ওঠা দেশের বৃহত্তম এক জনগোষ্ঠী এই সব ছিন্নমূল পথ শিশুরা সঠিক পরিচর্যার অভাবে দিনকে দিন অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অত্যন্ত নীরবে নিভৃতে।
ছবিঃ (সংগৃহীত)
মেহেদী হাসান (তুষার)