সাবা সিদ্দিকা সুপ্ত
খুব বড় একটা বটগাছের মতো সে। কেননা সে মূর্তিমান বটগাছের মতো হাজারটা দৃশ্যমান অন্যায়কে সহ্য করে যায়। বটগাছের মতোই অন্যসব নিরস পাষাণের হাড় থেকে শোষণ করার মতো শক্তি থাকলেও সে নিশ্চুপ। ফুটপাত দিয়ে হেটে যাবারসময় ছোট ছেলেদের ডাংগুলি খেলাগুলোকে বড্ড মিস করে ও। কারণ সে তার ছেলেবেলা হারিয়ে এসেছে। ব্যঙ্গাত্মকভাবে তার কোন ছোটবেলা ছিল না, শুধুমাত্র সাত বছর পর্যন্ত কাটানো মুহূর্তগুলোই ওর ছেলেবেলা। কিন্তু এর পরই শুরু হয়েছিল ওর করুণবেলা।
তখন প্রতি সকালে ওর ঘুম ভাঙত সাইকেলের বেলের আওয়াজ শুনে, যা ছিল একটা ছেলের পক্ষে অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সেই করুণবেলা সেদিন শুরু হয় যেদিন ওর ঘুম ভেঙেছিল লেইস ফিতা ওয়ালার আওয়াজ শুনে, যা নিজের কাছে স্বাভাবিক মনে হলেও অন্যদের কাছে হয়ে উঠেছিল ঘেন্নার। সামান্য কিছু মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে অন্য লিঙ্গে রূপান্তর হতে দেখাটা অন্তত সমাজের সবার কাছে না হোক তার কাছে ছিল জাদুর মতো। বিধাতার সেই অদ্ভুত ম্যাজিক যা তাকে সবার থেকে আলাদা করে দিয়েছিল।
সেদিনের পর থেকে তার গাঁয়ে কোন গেঞ্জি দেখা যায়নি; ছিল লাল টুকটুকে ফ্রক, মাথায় জড়ানো ওড়না, ঠোটে কড়কড়ে রঙের লিপস্টিক।
তৃতীয় ধাপের জীবনটাকে মেনে নেয়া তার পক্ষে যতটা নতুনত্বের হয়ে উঠল, তার পরিবারের কাছে ছিল ততটাই শঙ্কার আর আতঙ্কের। আট বছরের অবুঝ ছোট্ট শিশুটিকে তার পরিবার মেনে নেয়নি। তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গের পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তন ঘটেছিল পরিবারের সাথে তার সম্পর্কের।
সমাজের অগ্রাহ্যতা, মায়ের কান্না, বন্ধুদের কটুক্তি সেদিনের সেই অপার্থিব শিশুটিকে নিজের পরিবার ছাড়তে বাধ্য করেছিল। ঘর ছাড়া দশ বছরের একটি প্রাণী যে কত অপমান, কত নিষ্ঠুরতা সহ্য করে নিজের মতো দেখতে কিছু মানবিকতা সম্পন্ন মানুষের কাছে পৌঁছেছিল তা সবার কাছেই অজানা।
তৃতীয় লিঙ্গ, যাদেরকে আমরা ‘হিজড়া’ বলে কটাক্ষ করলেও নিজের কাছে সে অবিনাশী সত্ত্বা। তাদেরও ইচ্ছা করে কারো মা হতে, কারো বোন হতে। মা কিংবা বোন কেন, আমরা তাদেরকে একসাথে কাজ করার সুযোগই যেখানে দিচ্ছি না। তারা রাজনীতির মার বোঝে না, পেছন থেকে পায়ে কুড়াল বসাতে পারে না। তারা জানে সামনে থেকে এসে আমাদের গলায় ছুড়ি বসিয়ে খুচড়ো টাকা আদায় করতে। অন্তত সাদা মনে কাদা লাগানো এ্যাপ্রোনধারীদের থেকে তাদের নগ্নতার রূপ অপূর্ব, তাতে কোন পাশবিকতা লুকিয়ে থাকে না। তাদের মধ্যে মানবিকতার অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও তারা নিজেদের মানুষ বলতে লজ্জা পায়। আর আমরাই তাদের মতো প্রাণীকে নিগ্রহ করে নিজেদেরকে মানুষ বলে প্রতিনিয়ত দাবি করে আসছি। আমাদের জন্যই তারা এই সমাজে অসহায়, মূল্যহীন। আমরাই তাদেরকে বাধ্য করছি অশ্লীলতার আশ্রয় নিতে। সিংহকে খাঁচার মধ্যা বন্দী করে রাখলেও, সে নিজের খাঁচার মধ্যেই রাজা।
কিন্তু আমাদের একটু ভাল ব্যাবহার, খানিকটা আন্তরিকতাই পারে তাদের জড়তা কাটিয়ে মানুষ হিসেবে নিজের অধিকারের দাবি তুলে ধরতে।
ছবি-সংগৃহীত