রহিম শুভ
কারাগারের প্রধান ফটকে বড় অরে লেখা ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’ বাক্যটি এখন শুধুই শ্লোগান। কারণ কারাগারটি হুমকির মুখে। কিন্তু কারাগার কর্তৃপরে দাবি কারাগারের প্রতিটি বন্দিকে রাখা হয় নিবিড় পর্যবেণে। কঠোর অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে দেখানো হয় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার পথ। আসলে অনুসন্ধানে পাওয়া গেলে তার উল্টো চিত্র। এই কারাগারে যার যত বেশি প্রভাব, সে তত বেশি প্রভাবশালী। আর যাদের প্রভাব নেই তাদের হতে হয় সাজাপ্রাপ্তদের নির্যাতনের শিকার। তবে কারাগারের বাইরে এসব ঘটনা সহসা প্রকাশ করেন না কেউ। কারণ বেশির ভাগ হাজতি বিভিন্ন প্রকার অপরাধী হওয়ায় তাদের বারবার যেতে হয় কারাগারে।
অনুসন্ধানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, কারাগার কর্তৃপ সব সময়ই সংবাদকর্মীদের এড়িয়ে চলেন এবং তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় কঠোর গোপনীয়তা রা করেন। জেলা কারাগারের ভেতর ও বাইরের নানা সমস্যার খবর। অপরদিকে আসামীদের স্বজনরা জানিয়েছেন, বন্দিদের সঙ্গে সাাৎ করতে আসা স্বজনরা সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হন দেখার ঘরে। সেখানে ভালোভাবে কথা শোনা যায় না। কিন্তু কারারীদের সাহায্য চাইলে তারা আইনের বিভিন্ন অজুহাত তুলে ধরেন। কিন্তু পকেটে ৫০ টাকার নোট ঢুকিয়ে দিতেই তিনি সব আইনের কথা ভুলে যান। পরে দ্বিতীয়বারও দেখা করার ব্যবস্থা করে দেন তারা।
ঠাকুরগাঁও জেলা কারাগারে ধারণ মতার প্রায় ৪ গুন বেশি বন্দি থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন কয়েদি ও হাজতিরা। খাবার জোগাড় হলেও থাকার জায়গা মিলছে না অনেকের। গাদাগাদি করে অবস্থান করায় অসুস্থ হয়ে পড়ছেন তারা। সম্প্রতি পুলিশের বিশেষ অভিযানে অধিক সংখ্যক আসামী ও অপরাধী ধরা পড়ায় ও ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় জেলা কারাগারের আবাসিক সংকট প্রকট আকার ধারন করেছে। অতিরিক্ত বন্দিদের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় জেলা কারাগারে বন্দিদের জন্য নতুন করে কারাগার নির্মাণের প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।
কারাগার সূত্রে জানা গেছে, ব্রিটিশরা ১৮৯২ সালে বর্তমান ঠাকুরগাঁওয়ে একটি উপ-কারাগার স্থাপন করে। পরে ১৯৮৪ সালে তৎকালীন সরকার এটিকে জেলা কারাগারে রূপান্তর করে। শত বছর পূর্ণ হয়ে বর্তমানে বয়সের ভারে নূয়ে পড়েছে কারাগারটি। যেকোনো সময় হুড়মুড় করে ধসে পড়তে পারে বলে কারাগারে আটক বন্দিরা আশঙ্কা করছেন। তারপরও জরাজীর্ণ এ ভবনে চলছে বন্দিদের বসবাস সহ সব ধরনের প্রশাসনিক কার্যক্রম। জেলখানায় খাবারের মান খুবই নিম্নমানের বলে জানিয়েছেন একাধিক হাজতি। তবে কারাকর্তৃপক্ষ দাবি করেছেন, বন্দিদের উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়।
ঠাকুরগাঁও জেলখানার জেলার নাজিম উদ্দিন জানান, বন্দিদের সকালে রুটি ও গুড়, দুপুরে সবজি-ডাল-ভাত এবং রাতে সবজি-ডাল-ভাত-মাছ বা মাংস খেতে দেয়া হয়। বন্দিরাও জেলারের কথা অস্বীকার করেননি। তবে তাদের অভিযোগ খাবারের মান নিয়ে। একাধিক বন্দি জানান, খাবারের তালিকায় মাছের যে সাইজ উল্লেখ থাকে তা দেয়া হয় না। সম্প্রতি, জেল থেকে মুক্তি পাওয়া বন্দি মিজানুর রহমান জানান, তিনি ৯ মাস জেল খেটেছেন। আবাসন সংকটের কারণে কোনোদিন সোজা হয়ে ঘুমাতে পারেননি। একইভাবে দু’বছরের অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছু এক রাজনৈতিক নেতা জানান, একদিকে যেমন আবাসন সংকট, অন্যদিকে পানি ও স্যানিটেশনের সমস্যা রয়েছে কারাগারটিতে। একবার টয়লেটে যেতে হলে এক থেকে দেড়ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হয়, যা খুবই অমানবিক। কারাগারের অভ্যন্তরেও ফেনসিডিল বা ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি হচ্ছে, বাইরে থেকে এমন খবর শোনা গেলেও অনুসন্ধানে এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। তবে কারাগারের মাদক যে বিক্রি হচ্ছে না তাও ঠিক নয়। কারাগারে বিক্রি হওয়া মাদকের মধ্যে রয়েছে গাঁজা এবং ঘুমের ট্যাবলেট। কারা অভ্যন্তরে কারারী নিজেরাই এসব মাদকদ্রব্য সরবরাহ করছে বলে বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে।
প্রাচীন এই কারাগারটিতে ১৬৮ জন বন্দি থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। অথচ বুধবার পর্যন্ত ৩শত ৩৩ জন এই কারাগারে অবস্থান করছেন। ঠাকুরগাঁও জেলা কারাগারে ১৬৮ জন বন্দি থাকার জন্য বর্তমানে ৬টি ব্যারাক ও ১টি মহিলা ব্যারাক রয়েছে। এর বাইরে একটি হাসপাতালে ১০ জন বন্দির থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। কারাগারে বর্তমানে কোন বিদেশী বন্দি নেই। কেও যদি জামিন নিতে না পারে তাদের জন্য একটি বেসকারী সংগঠন প্যারালিগাল এইড কাজ করে যাচ্ছে কারাগারের সামনে। ঠাকুরগাঁও কারাগারের জেলার নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘কারাবিধি অনুযায়ী একজন বন্দির জন্য ৩৬ বর্গফুট আয়তন, ফাঁসির আসামির জন্য ৫৪ বর্গফুটের সেল এবং বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি ও হাজতির জন্য ২৪ বর্গফুট স্থান বরাদ্দ দেয়ার কথা। কিন্তু প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় আবাসন সংকট এখানে চরম আকার ধারণ করেছে।’ ঠাকুরগাঁও জেল সুপার বিতান কুমার মন্ডল জানান, ঠাকুরগাঁও শহরের জগন্নাথপুর এলাকায় ১৫ একক জমির উপর শীঘ্রই নতুন কারাগারের নির্মান কাজ শুরু হবে। ইতিমধ্যে কারাগারের জমির অধিকরনের কাজ চলছে। কারগারটি নির্মান হলে আবাসন সংকট আর দেখা দিবে না।