–শাকিল রেজা ইফতি
একটা গান , যা সংস্কৃতি নিয়ে বলবে- হারিয়ে যাওয়া কিংবা হারাতে বসা ঐতিহ্য , পরিচয়- সবটাকে তুলে ধরবে কিংবা বলবে অতীতে খানিকটা সময়ের জন্য হারিয়ে যেতে, তা তো গান হতে পারে না। এত যোগ বিয়োগের হিসেব দিয়ে কি আর গান হয় নাকি? গবেষণা পত্র আর গানের লিরিক- এই দুটো তো আলাদা বিষয়। প্রথমটা খুব কাটকোট্টা, আর দ্বিতীয়টা হল গতিশীল সময় আর প্রকৃতির চলমান অর্কেস্ট্রা, যা শুনতে আরাম লাগে- মস্তিষ্ক আর হৃদয়ের কোষে তোলে অনুরণন। কিন্তু এই গবেষণা আর গান- দুটোকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলাটাকে দূষণ বলা চলে কি না জানি না। তবে মোটা দাগে, এ দেশীয় চলমান প্রেক্ষাপটে যা দৃশ্যমান- তা হতাশারও বটে। অর্থ না বুঝেও পার্শ্ব কিংবা পশ্চিমের গানের ডিগডিগ শব্দে তরুণেরা নেচে নেচে ওঠে- এটাকে তো মেনে নেওয়া যায়না! নিশ্চয়ই আনন্দ লাভই মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। সাথে দরকার সুস্থতা, স্বজাত্যবোধের চর্চা, শ্রোতার মানসিক তৃপ্তি- আর অবশ্যই বোধগম্যতা। নিশ্চয়ই যা কিছু একান্তই ‘আমাদের’ গান, সেগুলোতে অভাব নেই এসবের। তাহলে গলদটা কোথায়, যার জন্য তরুণদের বিমুখ হয়ে যাওয়া। এভাবে চলতে থাকলে, এ জাতি তো একদিন রীতিমতো আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগবে।
একাত্তরের যুদ্ধে আমরা আমাদের অস্তিত্ব আর পরিচয়ের সবটুকু খুঁজে পেয়েছিলাম ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে। এই আওয়াজ শুনে ক্ষত বিক্ষত বীরের শরীরেও বয়ে যেত অদ্ভুত শিহরণ। আমাদের পরিচয় ছিল আমাদের অনুপ্রেরণা! মুক্তিযুদ্ধকালীন গানগুলো আমাদের দেশাত্মবোধের তৃষার্ত চারায় জল দিতো। নতুনভাবে জেগে উঠতাম সবাই। শত প্রলোভনও আমাদের সরাতে পারেনি সিদ্ধান্তের পথ থেকে। তাই যুদ্ধ। স্বাধীনতা।
আজ আমরা সেই নিজেদের ভুলতে বসেছি। তাই দরকার এমন কিছু, যা কানে কানে এসে বলে যাবে- কী আমাদের পরিচয়, কোথা থেকে আমরা, কেন আমরা, কেমন আমরা!
কাটকোট্টা শোনালেও তাই দরকার গবেষণা। গানে গানে আমাদের অতীতকে জাগিয়ে তোলা। যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ যা দরকার করা। এ তো আমাদের আত্ম-পরিচয় রক্ষার প্রশ্ন।
শিরোনামের তৃতীয় ‘গ’ গীতলবঙ্গ তাই-ই করছে। এটা আশার কথা। অতি সম্প্রতি গীতলবঙ্গের একটা গান দলটির ফেইসবুক ও ইউটিউব পেইজ থেকে মুক্তি পেয়েছে। শিরোনাম হল- ‘ধানের গান’। এই গানটির লিরিক আর দশটি গানের মতো নয়। এখানে উঠে এসেছে প্রায় অনেক গুলো ধানের নাম। গীতলবঙ্গ সম্পর্কে দলটির অন্যতম প্রধান শিল্পী জনাব বিদ্যুৎ সরকার বলেন-
‘আমরা সব সময় চেষ্টা করেছি গানের মধ্য দিয়ে এমন বিষয়কে উপস্থাপন করতে যা বাংলার কথা বলবে, বাঙালির কথা বলবে- যা একান্তই আমাদের। এই সময়ে যেটা খুবই প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। ইতিহাস- ঐতিহ্য-সংস্কৃতি তাই আমাদের গানের মূল বিষয়। চর্যাপদ, মঙ্গলকাব্য, ময়মনসিংহ গীতিকা, বৈষ্ণব পদাবলী, আধুনিক সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় যা আমাদের অতীতকে মনে করিয়ে দেয়- এসবই আমাদের গানের উৎস। ধানের গানটির জন্য আমরা কৃতজ্ঞ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের অফিসার তুহিন হালদারের কাছে। আমরা এরপর ধারাবাহিকভাবে পাখি, ফুল, নদী, মেঘ, রান্না আল্পনা বাংলার এসব বিষয়কে গানে তুলে ধরবো। গীতলবঙ্গ মনে করে সময়ের স্রোতে শুধু সামনে ছুটে চলা নয়, নিজেকে জানতে হলে পেছনে ফিরে তাকানোও প্রয়োজন।‘
গবেষণাধর্মী এই গানটি শুনলে জানা যায় অনেক গুলো গানের নাম। ধানগুলোর নাম হলঃ
শালি, বিন্নি, ঝাউলতা, ময়ূরলতা, দাদখানি, হলদিগোটা, চিংড়িমুড়ি, জলকুমারি, বেনামুড়ি, তিলকাচারি, কালোমেঘি, গেরুমুড়ি, চিনিগুড়া, সোনামুখি, কাজলকাঠি, শিশুমতি, আউশ, আমন, চন্দ্রকুলি, দুলাই, বাদল, সরিষাকুলি, লক্ষ্মীদীঘা, আকাশপালি, বনকামিনী, কটকতারা, কাজলবরণ, জোয়ালভাঙা, বালাম, বিরই, আশমতিয়া, কাটারিভোগ, মহিষদোলা, রাধুনিপাগল ফুলমুক্তা।
গানটির ইউটিউব লিংকঃ https://www.youtube.com/watch?v=c3y-e6Q1ZeE&feature=share
তবে যা ই হোক না কেন, গানে সৃষ্টিতে মস্তিষ্কের কথা শোনাটা যেমন দরকার, হৃদ স্পন্দন গুনতে পারাটা তেমনভাবেই অপরিহার্য। আশা করি, সব ‘গ’ এ কথা ভেবে চিন্তেই এগোবে।
লেখক:
শিক্ষার্থী
দ্বাদশ শ্রেণি, সেন্ট যোসেফ কলেজ, ঢাকা