ইভান পাল
প্রিয় পাঠক আজ আপনাদের সামনে এমনিই একজন গিটার জাদুকরের গল্প শোনাবো যিনি তারঁ গানে গানেই ছবি একেছিঁলেন কোন এক রুপালি গিটারের।
সেই তুমি কেনো এত অচেনা না হলে।
সেই আমি কেনো তোমাকে দু:খ দিলে।।
কেমন করে এতো অচেনা হলে তুমি,
কিভাবে এতো বদলে গেছি,
এই আমি।
আপনারা অনেকেই হয়তো উপরের এই চার লাইনের গান শুনে মনে মনে গুন গুন করতে শুরু করে দিয়েছেন। হয়তোবা আবার অনেকেই বলছেন- ব্যাস, ব্যাস; আর বলতে হবে না। বুঝতে পেরেছি কার কথা বলতে চাইছেন। কি তাই তো?
ঠিক তাই, প্রিয় পাঠক। আজ আপনাদের সামনে এক লক্ষ সাত চল্লিশ হাজার পাচঁশ সত্তর বর্গমাইলের এই ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকোর বাংলাদেশের এক গিটার জাদুকরের গল্প জুড়বো। যিনি আইয়ুব বাচ্চু নামেই সারা বাংলাদেশেই পরিচিত। তবে সারা বাংলাদেশ বললে কোথাও যেনো একটু খামতি থেকে যায়।
তাই যদি বলি- এই গিটারের জাদুকর শুধুমাত্র সারা বাংলাদেশের না, এই উপমহাদেশের কিংবা সারা পৃথিবীর তবে জানি বাংলাদেশি হিসেবেই ষোল কলাই পূর্ণ হয়ে যায়। কারণ, আমরা চিৎকার করে সারা পৃথিবী কে বলি আমাদের মিউজিকে একটা আইয়ুব বাচ্চু আছেন। একটা গিটার জাদুকর আছেন। যিনি তারঁ গান দিয়েই রুপালি গিটার একেঁছিলেন।
১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট বন্দরনগরী খ্যাত চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার খরনা ইউনিয়নের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে এই গিটার জাদুকর জন্মগ্রহণ করেন। মোহাম্মদ ইসহাক ও মৃত নুরজাহান বেগম দম্পতির সন্তান তিনি। তারা ছিলেন তিন ভাই এবং এক বোন। আর তিনি ই ছিলেন ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। তারঁ মা মারা গেলেও তারঁ বাবা এখনও জীবিত রয়েছেন। তবে তারঁ পরিবার প্রদত্ত নাম ছিলো রবিন।
আইয়ুব বাচ্চু শৈশব থেকেই প্রচুর গান শুনতেন। আধুনিক গান, লোকগীতি তো শুনতেনই সেই সাথে ক্লাসিক্যাল গানের পাশাপাশি শুনতেন প্রচুর ওয়েস্টার্ন গান। আর শুনতে শুনতে গাইবার চেষ্টা এবং একসময় নিজেও গাইতে শুরু করলেন। তবে সঙ্গীতে তারঁ কোন প্রকার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। আর তারঁ পরিবারেও সংগীতের জন্য কোনরকম অনুকূল পরিবেশ ছিলো না। তাই ঐ স্কুলজীবনেই গান করার একটু-আধটু চেষ্টা আর তারপরেই সেই স্কুলজীবন থেকেই এভাবে নিজ চেষ্টায় গায়ক হয়ে ওঠা। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে না- “গাইতে গাইতে গায়েন”।
আইয়ুব বাচ্চুর গায়ক হয়ে ওঠার ব্যাপারটা জানি অনেকটা ঐরকমই।
এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,
ছেলেবেলায় গান শুনতে শুনতে নিজে চেষ্টা করতে গিয়েই তার গায়ক হয়ে ওঠা। পশ্চিমা সংগীতের প্রেমে পড়ে হাত দেন গিটারে।
আইয়ুব বাচ্চুর অনুপ্রেরণা ছিলো জিমি হেন্ডরিক্স, জো স্যাটরিনি, স্টিভ মুরের মতো বিশ্ব খ্যাত সব শিল্পীরা। তিনি পড়াশুনা করেছিলেন চট্টগ্রাম সরকারী মুসলিম হাই স্কুল এবং চট্টগ্রাম কলেজে।।
তিনি সত্তরের দশকের দিকে গিটার বাজানো শুরু করেন এবং খুব অল্প সময়েই সে স্থানটিতেও দক্ষতার পরিচয় দেন। গিটার বাজানোতে অসাধারণ দক্ষ হয়ে ওঠেন। তবে গিটারের ক্ষেত্রে তারঁ অনুপ্রেরণা বিশ্ব বিখ্যাত সব শিল্পী হলেও মূল অনুপ্রেরণা তিনি কিন্তু তারঁ দেশ থেকেই পেয়েছিলেন।
একবার ছোটবেলায় তিনি টিভিতে বাংলাদেশের পপ গুরু আযম খানের অনুষ্ঠান দেখছিলেন। সেখানে সবই ঠিক ভাবেই চলছিলো। সব বাদ্য যন্ত্রও ঠিকভাবে বাজছিলো। বাচ্চুরও বেশ ভালোই লাগছিল।
কিন্তু একটা বাদ্যে তারঁ চোখ আটকে গেলো। তিনি মন্ত্র মুগ্ধের মতো শুনতে লাগলেন আর দেখতে লাগলেন। সে যন্ত্রের নাম গিটার। আর সে গিটারের গিটারিস্ট ছিলেন এদেশীয় আরেক গিটারের বস নয়ন মুন্সি।
আচ্ছা প্রিয় পাঠক, আপনারা নয়ন মুন্সিকে চেনেন? অনেকেই বলছেন হয়তো, কে এই নয়ন মুন্সি কিংবা কি সব আরো অনেক কিছু। আমি নিজেও ইউটিউব কিংবা গুগলে সার্চ দিয়ে নয়ন মুন্সি রিলেটেড খুব একটা কিছু পাইনি।
আসলে এই গুপ্ত শিল্পীকে নিয়ে খুব একটা লেখালেখি হয়নি । পাঠকদের হাল্কার উপর ঝাপসাভাবেই জানিয়ে দেয় তবে নয়ন মুন্সি নিয়ে:
পুরা নাম নয়ন হক মুন্সি । ঢাকার শান্তিনগরের পিরসাহেবের গলিতে থাকতেন। আচ্ছা আপনারা পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নেওয়া শিল্পী আলমগির কে চিনেন? তারঁ কন্ঠে গাওয়া ভাটিয়ালি র সেই বিখ্যাত গান:
আমায় ভাসাইলি রে আমায় ডুবাইলি রে
আজো মানুষের মুখে মুখে। হ্যাঁ গানটি অনেকেই করেছেন। কিন্তু তারঁ কন্ঠে এই গান টি জানি আলাদারকম কদর পায়। সেই শিল্পী আলমগীরই হলেন এই নয়ন মুন্সির বড় ভাই । তারঁ আর এক ভাই হলেন দস্তগির হক মুন্সি। ১৯৬৮ সালের দিকে গড়া ব্যান্ড দ্য উইন্ডি সাইড অব কেয়ার। এটাতেও ভোকাল ছিলেন দস্তগীর তখনকার একমাত্র ইংলিশ ভোকাল। নয়ন মুন্সির বেড়ে ওঠাটা তাই রক অ্যান্ড রোলের মধ্যেই।

আচ্ছা প্রিয় পাঠক, আপনাদের হ্যাপি আখন্দের সেই বিখ্যাত গানটি মনে আছে?
“আবার এলো যে সন্ধ্যা
শুধু দুজনে
চলো না ঘুরে আসি অজানাতে
যেখানে নদী এসে থেমে গেছে।”
এই গানটিতে গিটারে কে ছিলেন জানেন? এই নয়ন মুন্সি। যা হয়তো অনেকে জানেন না। ১৯৭৫ সালের শেষদিকে এসে আযম খান নতুন করে “উচ্চারণ” ব্যান্ডের লাইনআপের ঘোষণা দিলেন। যেখানে ছিলো না কোনো কিবোর্ডিস্ট। নয়ন মুন্সি সহ আর দুজন গিটারিস্ট আর আযম খান। কীবোর্ড ছাড়াই ফাটিয়ে দিলো উচ্চারণ। কিন্তু জীবনের পাতাতে খুব বেশিদিন টেকেন নি শ্রেষ্ট এই গিটারিস্ট।
১৯৮১ সালের ২১ অক্টোবর নয়ন মুন্সি কানাডায় মৃত্যুবরণ করেন। (Ashik Music এর Facebook Page থেকে সংগৃহীত)। তো, আইয়ুব বাচ্চু এই নয়ন মুন্সির গিটার বাদন দেখেই গিটারের প্রেমে পড়েন। আর তারপর সেই গিটার নিয়ে টুংটাং চেষ্টা আর বর্তমানে উপমহাদেশের শ্রেষ্ট গিটারিস্টের আসনে ভক্তদের ভালোবাসায় অধিষ্ঠিত হওয়া।
কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে আইয়ুব বাচ্চু গড়ে তোলেন একটি ব্যান্ড দল। শুরুতে যদিওবা ব্যান্ডটির নাম দেওয়া হয়েছিলো গোল্ডেন বয়েজ। কিন্তু পরে অবশ্য ব্যান্ডটির নাম বদলে রাখা হয় আগলি বয়েজ। পাড়া-মহল্লার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে চলত এই ব্যান্ডের পরিবেশনা।
এবার আসি আইয়ুব বাচ্চুর পেশাদার ব্যান্ড সংগীত জীবনের গল্পে। তিনি পেশাদার ব্যান্ড সংগীত শিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন ১৯৭৮ সালে, ব্যান্ড দল ফিলিংস এর সাথে। আর সেই সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে পারফর্ম করতেন তিনি ও তারঁ ব্যান্ডদল ফিলিংস।
একবার এক সাক্ষাতকার অনুষ্ঠানে তিনি সেই সময়ের কথা স্মরণ করে তিনি বলেছিলেন,
“চট্টগ্রামের অলিগলিতে রাতের পর রাত আমি গিটার হাতে বেড়িয়েছি। কাঁধে গিটার নিয়ে বিয়ে বাড়িতে হাজির হয়েছি। গিটার বাজিয়েছি। চট্টগ্রাম আমার নাড়ি পোঁতা শহর। এ শহরে আমার মা ঘুমিয়ে আছেন। এ শহরেই আমি আবারও ফিরে আসব।”
এর ঠিক দুবছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯৮০’র দিকে তিনি যোগ দেন জনপ্রিয় ব্যান্ড দল সোলস এ। টানা দশ বৎসর তিনি ব্যান্ড সোলসের লিড গিটারিস্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন। সাথে আবার সোলসে গানও করতেন। এরই মাঝে তিনি কন্ঠ দেন তারঁ জীবনের প্রথম গানে।
তার কন্ঠ দেয়া প্রথম গান ছিলো হারানো বিকেলের গল্প । গানটির কথা লিখেছিলেন বিখ্যাত গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। আইয়ুব বাচ্চু ভীষণ রকম গান পাগল ছিলেন। তিনি যেখানেই যেতেন সেখানে সুর, তাল, লয় আর ছন্দে ডুবে থাকতেন। আর এ প্রসঙ্গে এল.আর.বি. ‘র ফেসবুক পেইজে একটা লেখা ছিলঃ
সাল টা ১৯৯১। কোন এক ফাগুনের দিনে ‘সোলস’ এর গিটারিস্ট সুহাসের চট্টগ্রাম হিল বর্তমানে ফরেস্ট কলোনি এলাকার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল সবাই।
সঙ্গে ছিলেন খ্যাতিমান গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গি। সেখানে যাওয়ার পরে সবাই মিলে আশপাশের পাহাড় অরণ্য ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। আইয়ুব বাচ্চু যেখানেই বেড়াতে যেতেন সেখানেই তিনি তারঁ প্রিয় ইন্সট্রুমেন্ট গিটার সাথে করে নিয়ে যেতেন। তো, সবাই যখন মুগ্ধ প্রকৃতি দেখায় ব্যস্ত তখন আইয়ুব বাচ্চু গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গিকে প্রস্তাব দিলেন — “জঙ্গি ভাই এমন সুন্দর পরিবেশে গান ছাড়া কি চলে? চলুন আমরা কোনো গান তোলার চেষ্টা করি
আইয়ুব বাচ্চুর প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হয়ে যান গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গি।। আর খাতায় টুসটুস করে লিখে ফেলেন,
একদিন ঘুম ভাঙা শহরে
মায়াবী সন্ধ্যায় চাঁদজাগা একরাতে
একটি কিশোর ছেলে,
একাকী স্বপ্ন দেখে
হাসি আর গানে সুখের ছবি আঁকে
আহা কি যে সুখ।
তবে গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গি সেদিন এ চার লাইনের পর আর লিখলেন না। অন্য মনস্ক হয়ে গেলেন। এরপর ১৯৯১ সালেই বিটিভির কোন একটি ব্যান্ড শো অনুষ্ঠানে সোলসের ডাক পড়ে যেখানে আরও ছিল মাইলস, ফিডব্যাক, চাইম, অবসকিউর সহ তখনকার সময়ের জনপ্রিয় ব্যান্ডগুলো। তখন সোলসের ভোকাল ছিলেন তপন চৌধুরী। তিনি ব্যক্তিগত কারণে অনুপস্থিত ছিলেন। সোলসের সদস্যরা নতুন গান নিয়ে ভাবনায় পড়ে যান।
আর আইয়ুব বাচ্চু’র মাথায় তখন ই চট করে চলে আসে কিছুদিন আগে সেই ফরেস্ট হিলে গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গি যে গানটির মুখ তৈরি করেছিলেন সেই গানটির কথা। গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গি কে অনুরোধ করলেন গানটির বাকী অন্তরাগুলো দ্রুত লিখে দিতে যাতে করে বিটিভির সেই ব্যান্ড শোতে নতুন গান নিয়ে ‘সোলস’ উঠতে পারে। ব্যান্ড শো অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং এর আগের দিন গীতিকার জঙ্গি সহ সোলসের নতুন সদস্য পার্থ বড়ুয়াকে নিয়ে আইয়ুব বাচ্চু হোটেল ব্লু নাইনের কক্ষে বসলেন।
আর সেখানে বসেই “একদিন ঘুম ভাঙ্গা শহরে” গানটির বাকী অংশ লিখে ফেললেন । পুরো রাত জেগে একটানা গানটি নিয়ে কাজ করলেন আইয়ুব বাচ্চু সহ সোলসের বাকী সদস্যরা। আর সেই সাথে গানটি পুরোপুরিভাবে তৈরি করে ফেললেন। পরের দিন সকালেই অত্যন্ত ক্লান্ত, এবং নিদ্রাহীন অবস্থায় “একদিন ঘুম ভাঙ্গা শহরে’’ গানটি পরিবেশন করে এলো সোলস। সেদিন কীবোর্ডের দায়িত্বে ছিলেন পার্থ বড়ুয়া। আর মূল শিল্পী ও লিড গীটার দুটোর দায়িত্বেই ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। আর এটিই ছিল “সোলস” এর সাথে টেলিভিশনের পর্দায় আইয়ুব বাচ্চু’র কণ্ঠের প্রথম সম্পূর্ণ পরিবেশনা। এর আগে বহুবার সোলসের সাথে আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন কিন্তু ব্যান্ডের মূল ভোকালের দায়িত্বে ছিলেন তপন চৌধুরী।
আর এ ঘটনাটির ৪ থেকে ৫ মাস পর অর্থাৎ ৯১এর শেষ দিকে সোলসের সাথে আইয়ুব বাচ্চু’র কিছু কারণে ভুলবুঝাবুঝি এবং ব্যক্তিগত দূরত্ব তৈরি হয়। আর সেদিনই “হোটেল ব্লু নাইনে” বসেই সোলসের সাথে শেষবারের মতো সব হিসাব নিকাশ চুকিয়ে সোলস ব্যান্ড থেকে চিরতরে অবসরে যান লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চু। তবে সম্পূর্ণ ব্যান্ড সংগীত জগৎ থেকে না শুধুমাত্র সোলস থেকেই তিনি অবসর নেন।
আবার সেই সাথে সোলসের থেকে অনুমতি নিয়েই “একদিন ঘুম ভাঙ্গা শহরে’” গানটি সাথে করে নিয়ে এলেন । সেদিন তারঁ দীর্ঘদিনের আবাসস্থল “হোটেল ব্লু নাইনের” কক্ষ ও ছেড়ে দিয়েছিলেন। সোলস ছেড়ে দেয়ার মাত্র মাস ছয়েকের মাথায় অর্থাৎ ১৯৯১ সালের ৫ ই এপ্রিল আইয়ুব বাচ্চু গড়ে তোলেন নতুন ব্যান্ড এলআরবি (L.R.B.)।
তার সেই সময়কার ব্যান্ড সঙ্গী ছিলেন জয়, স্বপন আর বাংলাদেশের আরেকজন খ্যাতিমান শিল্পী এসআই টুটুল। যার মূল ভোকাল ও গীটার এবং ব্যান্ড লিডারের দায়িত্ব লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চু নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন। আর এভাবেই যেনো শুকনো ঘাসের শিশির ভেজা পথ ধরে শুরু হয় লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চু’র নতুন এক পথচলা। সোলসের সেই গিটারিস্ট সুহাসের ফরেস্ট হিলের বাসায় বসে লিখা আরেকটি গান ছিলো, “তুমি ছিলে”। এই গানটি আইয়ুব বাচ্চু যখন সোলসে ছিলেন তখন তা নিয়ে কাজ করা হয়নি। যার ফলে গানটি আইয়ুব বাচ্চুর কাছেই থেকে যায়। পরে অবশ্য গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গির অনুমতি নিয়েই আইয়ুব বাচ্চু এলআরবি’র প্রথম অ্যালবামে যুক্ত করেন সেই গানটি।
“তুমি ছিলে” গানটির গীতিকার ছিলেন শহীদ মাহমুদ জঙ্গি, সুরকার ও কণ্ঠ দিয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। আর যে গানটি দিয়ে তিনি সোলসের সাথে সর্বপ্রথম টেলিভিশনে পারফর্ম করেন আরে যে গানটি তিনি সোলসের অনুমতিতে নিয়ে এসেছিলেন। নিজের সুর করা সেই ‘‘একদিন ঘুম ভাঙ্গা শহরে’’ গানটি দিয়েই এলআরবির প্রথম অ্যালবাম শুরু করেন যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতে এক কালজয়ী ইতিহাস সৃষ্টি করে। আর এরপরে এল.আর.বি. কিংবা এই গিটার জাদুকর কে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সাইঁ সাইঁ করে ওপরের দিকে উঠে গেছেন। আর বাংলার ব্যান্ড সংগীত জগৎ কে কাপিয়েই গিয়েছেন। আর জয় করেছেন একের পর এক ভক্তদের মন।
(এল.আর.বি.’র ফেসবুক ফ্যান পেইজ থেকে সংগৃহীত)
সোলসে থাকাকালীন সময়েই প্রকাশিত হয় তারঁ প্রথম একক অ্যালবাম রক্ত গোলাপ। যেটি বাজারে আসে ১৯৮৬ সালে। যদিওবা এই অ্যালবাম টি খুব একটা সাফল্য পায়নি।
১৯৮৮ সালে আবারো তারঁ একক অ্যালবাম বাজারে আসে। কিন্তু এবার আর তিনি খালি হাতে ফিরলেন না। এবার তিনি সব থেকে দামি উপহার, ভক্তদের মন জয় করে ফিরলেন। “ময়না” অ্যালবামটিতে গায়ক হিসেবে বাচ্চু শ্রোতাপ্রিয় হতে শুরু করেন।
প্রথমদিকে অবশ্য এই এলআরবি ব্যান্ডের পুরো নাম ছিল, লিটল রিভার ব্যান্ড। পরবর্তীতে এই নামটি বদলে রাখা হয় লাভ রানস ব্লাইন্ড।
এলআরবি তাদের প্রথম কনসার্ট করেছিল ঢাকার একটি ক্লাবে। তবে সেখানে মূলত: ওয়াস্টার্ন ঘরানার ইংরেজি গানই পরিবেশন করেছিলেন তারা। কিন্তু এর কিছু দিন পর ঢাকা শিশু একাডেমিতে এক কনসার্টে প্রথমবারের মতো ক্লাব বা হোটেলের বাইরে গিয়ে দর্শকদের সামনে অনুষ্ঠান করতে আসে এলআরবি। আর এর মাধ্যমেই এলআরবি’র ক্লাব বা হোটেলের বাইরে গিয়ে বাইরের জগতের কাছে আত্মপ্রকাশ ঘটানো।
আচ্ছা এবার একটু এল.আর.বি.’র ব্যান্ড অ্যালবাম নিয়ে বলিঃ
তারঁ নিজ হাতে তৈরি করা ব্যান্ড এল.আর.বি.’র প্রথম নাম ভূমিকার ব্যান্ড অ্যালবাম ‘এলআরবি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। এই অ্যালবামের ‘শেষ চিঠি, কেমন এমন চিঠি’, ‘ঘুম ভাঙ্গা শহরে’, ‘হকার’ গানগুলো দারুণ ভাবে সাড়া ফেলেছিল।
১৯৯৩ সালে এল.আর.বি.’র দ্বিতীয় ব্যান্ড অ্যালবাম “সুখ” প্রকাশ পায়।
“সুখ” অ্যালবামটির কিছু কিছু কালজয়ী গান আজো সবার মুখে মুখে। ‘সুখ’, ‘চলো বদলে যাই’, ‘রূপালি গিটার’, ‘গতকাল রাতে’ এই গানগুলো সারা দেশের ভক্তদের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই অ্যালবামের ‘চলো বদলে যাই’ গানটি বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় একটি গান। বলা চলে, গানটি ছাড়া বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত জগতের কথা ভাবাই যায় না। প্রায় যেকোন ব্যান্ড সংগীতের অনুষ্ঠানেই এই গানটি না গাইলে যেনো কিছু একটা অপূর্ণই থেকে যায়। আর গানটির কথা লিখেছেন এবং সুর করেছেন আইয়ুব বাচ্চু নিজেই।
১৯৯৫ সালে আবারো প্রকাশিত হয় আইয়ুব বাচ্চুর তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। বলা হয়ে থাকে, এটিই নাকি সর্বকালের সেরা একক অ্যালবামের একটি। আর এই অ্যালবামটির প্রায় সবগুলো গানই শ্রোতা মহলে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিশেষ করে অ্যালবামটির ‘কষ্ট কাকে বলে’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘অবাক হৃদয়’, ও ‘আমিও মানুষ’ এই গানগুলো।
আর ঠিক একই বছরেই তাঁর চতুর্থ ব্যান্ড অ্যালবাম ‘ঘুমন্ত শহরে’ প্রকাশিত হয়। সেটিও দারুণ ভাবে সাফল্য পায়। আর এভাবেই একে একে তারঁ ব্যান্ড থেকে বারোটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়।
তারঁ ব্যান্ড থেকে প্রকাশিত অ্যালবামের তালিকাটি পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো:
এলআরবি-১ ও ২ (১৯৯২), সুখ (১৯৯৩), তবুও (১৯৯৪), ঘুমন্ত শহরে (১৯৯৫), স্বপ্ন (১৯৯৬), আমাদের বিস্ময় (১৯৯৮), মন চাইলে মন পাবে (২০০১), অচেনা জীবন (২০০৩), মনে আছে নাকি নাই (২০০৫), লাইভ অ্যালবাম ফেরারি মন (আন প্লাগড ১৯৯৬), স্পর্শ (২০০৮)।
আর তারঁ একক অ্যালবামগুলি হলোঃ রক্তগোলাপ (১৯৮৬), ময়না (১৯৮৬), কষ্ট (১৯৯৫), সময় (১৯৯৯), একা (১৯৯৯), প্রেম তুমি কী (২০০০), দুটি মন (২০০২), কাফেলা (২০০২), প্রেম প্রেমের মতো (২০০৩), পথের গান (২০০৪), ভাটির গানে মাটির টানে (২০০৬), জীবন (২০০৬), সাউন্ড অব সাইলেন্স-ইন্সট্রুমেন্টাল (২০০৭), রিমঝিম বৃষ্টি (২০০৮) ও বলিনি কখনও (২০০৯)।
আর ২০১৫ সালে তারঁ সবশেষ একক অ্যালবাম “জীবনের গল্প” প্রকাশিত হয়। এই অ্যালবামটিতে সর্বমোট ১০টি গান রয়েছে। গানের কথা লিখেছেন সাজ্জাদ হোসাইন এবং আইয়ুব বাচ্চু নিজেই এই অ্যালবামের সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন।
আইয়ুব বাচ্চু চলচ্চিত্রের প্লে ব্যাক গানেও কাজ করেছেন। আইয়ুব বাচ্চু লাল বাদশা, গুণ্ডা নাম্বার ওয়ান, ব্যাচেলর ও চোরাবালি সিনেমাগুলোতে প্লেব্যাকের কাজ করেছেন। চলচ্চিত্রে তারঁ গাওয়া প্রথম গান ছিলো, ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’।এটি তাঁর গাওয়া প্রথম চলচ্চিত্রের গান। আর গানটি দারুণ সাফল্য কুড়িয়েছিল।
এছাড়া তারঁ গাওয়া আরেকটি বিখ্যাত গান হলো, ‘আম্মাজান’ ছবির “আম্মাজান” শিরোনাম গানটি। এটি শ্রোতা মহলে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই দুটি গান আজো মানুষের মুখে মুখে।
রবিন কিংবা সকলের প্রিয় এবি কিংবা আইয়ুব বাচ্চু যাই হোক না কেনো তিনিই কিন্তু বাংলাদেশের এক অদ্বিতীয় গিটার জাদুকর। শুধু এদেশের ই নয় তিনি এই সমগ্র উপমহাদেশেরই সেরা গিটারিস্ট ছিলেন।
আচ্ছা, এবার একটু অভিনেতা আইয়ুব বাচ্চুর গল্প বলি।
ক্যালেন্ডারের পাতায় যখন সালটা যখন ২০১০ তখন তিনি ঈদের জন্য নির্মিত নাটক “ট্রাফিক সিগন্যাল ও হলুদ বাতি” এই শিরোনামের নাটকে তিনি তারঁ জীবনে প্রথমবারের মতো নাটকে অভিনয় করেছিলেন।
প্রিয় পাঠক এতক্ষণ তো আপনারা শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর গল্প শুনলেন। এবার আপনাদের একটু দেশপ্রেমিক আইয়ুব বাচ্চুর গল্প শোনাই।
“বিদেশি এক গিটারের দোকানে গিয়ে এক বাংলাদেশি ভদ্রলোক কাছাকাছি রাখা গিটারগুলো নেড়েচেড়ে দেখছেন। হঠাৎ অদূরেই একটা গিটারের উপর চোখ পড়ল তার। কাঁচের বাক্সে বন্দী। দোকানিকে এটার কথা বলতেই সে ভদ্রলোকের আপাদমস্তক একবার পরখ করে নিলেন। তারপর দোকানি সেই ভদ্রলোক কে কোন দেশ থেকে এসেছেন তা জিজ্ঞেস করলেন। তারপর দোকানি সেই ভদ্রলোক কে যা বলল তার অর্থ দাঁড়ায়, “এই গিটার তোমার মত বাংলাদেশি লোকের জন্য না, এটা এখানকার সবচেয়ে দামি গিটার, তুমি বরং অন্যটা দেখ”। সেই ভদ্রলোক দোকানির এই কথায় সবচেয়ে কষ্ট পেলেন এই ভেবে যে বাংলাদেশের এক লোককে তারা মোটামুটি অপমানই করল।
ভদ্রলোক তখন দোকানিকে বললেন, “তুমি একবার আমাকে গীটারটা একটু দেখতে দাও, আমি এবং আমার টিমের কাছে যত ডলার আছে আশা করি আমরা এটা নিতে পারব”। দোকানি কিছুটা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে গিটারটা দেখতে দিল । তারপরেরটা একটা ইতিহাস ই ছিলো বলা যায়।
যেকোন গিটারই হাতে পেলে সে ভদ্রলোক যেন কেমন হয়ে যান। সে ভদ্রলোক সে দোকানের সামনেই এমনভাবে বাজানো শুরু করলেন যে আশপাশে জনসমাগম হয়ে গেল। সেই দোকানির চোখ তখন আকাশ স্পর্শ করেছে।
ভদ্রলোক গিটার বাজানো শেষে ফেরত দিতে গেলে দোকানি বলল, “তুমি তো অসাধারণ বাজাও, এই গিটারতো তোমার জন্যই, এটা আমি তোমাকে অর্ধেক দামেই দিব”। তখন সে দোকানিকে সেই ভদ্রলোক বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “এটা তুমি আমাকে বিনে পয়সায় দিলেও আমি নিব না, তুমি আমার দেশকে অপমান করেছ”।
দোকানি ক্ষমা চাইলেও সেই গিটার সে ভদ্রলোক টিকে আর দিতে পারল না। আর সেই ভদ্রলোকটির নাম হচ্ছে আমাদের সকলের প্রিয় আইয়ুব বাচ্চু বা এবি। যে গিটারের জন্য দেশ অপমানিত হয়, সেই গিটার আইয়ুব বাচ্চু দ্বিতীয়বার বাজায় না।
(আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর পর দেশ বরণ্য সংগীতশিল্পী আখিঁ আলমগীরসহ অনেকেই এই আবেগঘন স্ট্যাটাসটি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন তা থেকেই মূলত: সংগ্রহ করা)।
আইয়ুব বাচ্চু ব্যক্তিগত জীবনে বিয়ে করেছিলেন ফেরদৌস আইয়ুব চন্দনাকে। চন্দনা-আইয়ুব দম্পতির জীবনে তাদের তাজওয়ার নামে একটি পুত্রসন্তান এবং ফাইজুর নামে একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। তার ছেলে ও মেয়ে দুজনেই কানাডায় পড়াশোনা করছেন।
২০১৪ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ‘টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ~এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে “বিসিবি সেলিব্রেশন কনসার্ট” এ গান পরিবেশন নিয়ে মাইলস ব্যান্ডের হামিন আহমেদ-এর সাথে বাচ্চুর বিরোধ সৃষ্টি হয়। আর এই দ্বন্দ্বের সূত্রে আইয়ুব বাচ্চু এবং তারঁ ব্যান্ড এল.আর. বি. বাংলাদেশ ব্যান্ড মিউজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বামবা) সদস্যপদ প্রত্যাহার করে। পরে অবশ্য এ বিরোধ মিমাংসা হয় এবং তিনি আবারো বামবা’র সদস্যপদ গ্রহন করেন।
২০১৬ সালে বাংলাদেশের বিখ্যাত দৈনিক প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন,
“আমার সন্তানেরা ছোটবেলা থেকে আমার মুখে একটা গল্প শুনতে অভ্যস্ত। এই ঢাকা শহরে ১৯৮৩ সালের শেষের দিকে মাত্র ৬০০ টাকা নিয়ে এসেছিলাম। উঠেছিলাম এলিফ্যান্ট রোডের একটি হোটেলে।
ঢাকা শহরে আমি যখন ৬০০ টাকা নিয়ে আসি, তখন এখানে আমার অনেক আত্মীয়স্বজন থাকতেন। আমি কারও কাছেই যাইনি। বিপদে কারও মুখাপেক্ষীও হইনি। নিজেকে গড়ে তুলেছি। কাজে হাত দিয়েছি। কাজের পর কাজ করেছি। এখনো করেই যাচ্ছি। দিনরাত্রি কাজ করে একটা অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছি।
আমার কাছে ওই ৬০০ টাকা ছিল ৬ কোটি টাকার মতোই। সামনে অনেক পথ খোলা ছিল। সবকিছু পাশ কাটিয়ে গেছি। চলার পথে এমন কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় ছিল, যাদের নাম শুনলে আতঙ্কিত হতে হতো। শুধু তা-ই নয়, আমার পরিচিত অনেকে মাদকসেবনও করত। চাইলে আমিও হয়তো বখে যেতে পারতাম। কিন্তু মিউজিকই ছিল আমার ধ্যানজ্ঞান। আমি সেই লক্ষ্যে ছুটে গেছি।
১০ বছর লেগেছে আমার সেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে। এই ১০ বছরে আমি ভেসে যেতে পারতাম। হয়তো আমার কোনো পাত্তাই পাওয়া যেত না। কিন্তু আমি ভাসিনি। আশপাশে নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে। অনেক ধরনের লাইফস্টাইলের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। কিন্তু যে লাইফস্টাইল আমার পরিচিত না, যেটার সঙ্গে আমার পরিবার একমত না—এ ধরনের লাইফস্টাইল থেকে নিজেকে সংবরণ করেছি। কারণ, আমার মা কষ্ট পেলে দেশ কষ্ট পাবে। আত্মীয়স্বজনেরা মন ছোট করবেন। দেশ কষ্ট পেলে দুনিয়া কষ্ট পাবে। এ জন্যই নিজেকে সংবরণ করেছি। আমি বলতে চাই, লোভ সংবরণ করা খুব দরকার।”
প্রথম আলোকে দেওয়া তারঁ এ সাক্ষাৎকার টি এখানে তুলে ধরলাম একটাই কারণে। আর তা হচ্ছে, বর্তমানে অনেকেই মনে করেন মিউজিক মানেই নেশা ভাং করা। মিউজিক করলেই নেশা করতেই হবে। এমনিতে মিউজিক হয়না। এই ধারণা যে সম্পূর্ণ ভুল, সম্পূর্ণ অকাট্য তার প্রমাণ আইয়ুব বাচ্চুর এই কথাগুলো। নেশা করাটাই কোনভাবেই মিউজিক নয়। বরং মিউজিক অনেক উচুঁ দরের বিদ্যা। বলা হয় থাকে, পৃথিবীর শ্রেষ্ট যে ৬৪টি কলা আছে তার মধ্যে এই মিউজিক অন্যতম। তাই নিজেদের সংযত করতে হবে আর প্রচুর শিখতে হবে আর এগিয়ে যেতে হবে বহুদুর। এ শিক্ষাটি কিন্তু আমরা এই লিজেন্ডের সাক্ষাতকার, তারঁ জীবনী থেকে পাই।
আইয়ুব বাচ্চুকে কোন এক সাক্ষাৎকারে তারঁ জীবনের অনুপ্রেরণার কথা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। আর তখন এই লিজেন্ড বলেছিলেন, “আগের মতো এখন অনেক কিছুই আমাকে আর অনুপ্রাণিত করে না। এখন বেঁচে থাকাটা আমার ভক্ত-শ্রোতাদের জন্য, যারা আমাকে ভালোবাসেন। যারা আমার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভিজেন। যারা প্রচণ্ড রোদে পুড়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করেন। যারা আমার প্রতি স্নেহ-মমতা প্রকাশ করেন। এখন নতুন কোন স্বপ্ন দেখি না যার জন্য আমাকে বেঁচে থাকতেই হবে”।
চট্টগ্রামের তরুণ শিল্পীদের জন্য আইয়ুব বাচ্চু “এবি লাউঞ্জ” নামে নতুন একটি প্লাটফর্ম তৈরির কাজ শুরু করেন এবং সেই সাথে তারঁ বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের চর্চার জন্য একটি মিউজিক্যাল একাডেমি করারও ইচ্ছে ছিল।
এইতো সেদিন অর্থাৎ গত ২৪ আগস্ট আইয়ুব বাচ্চু সাংবাদিকদের বলেছিলেন,
“আমি চট্টগ্রামের সন্তান। তাই চট্টগ্রামের জন্য কিছু করে যেতে চাই। আমি সারাজীবন গাইতে পারব না। কিন্তু আমি চাই চট্টগ্রাম থেকে আমার মতো আরও কেউ উঠে আসুক। চট্টগ্রামের উদীয়মান শিল্পীদের জন্য আমি একটা প্লাটফর্ম তৈরি করে দিয়ে যেতে চাই। চট্টগ্রামে এবি লাউঞ্জ হবে ব্যান্ড সংগীত এবং উদীয়মান ব্যান্ড শিল্পীদের জন্য নতুন একটি সম্ভাবনার দ্বার।”
কিন্তু অত্যন্ত দু:খের ব্যাপার হচ্ছে, চট্টগ্রামের তরুণ উদীয়মান শিল্পীদের জন্য যে প্ল্যাটফর্ম তিনি তৈরি করতে চেয়েছিলেন তা আর তিনি তৈরি করে যেতে পারলেন না। নিজেই যেমন নিজের গানে রুপালি গিটার সৃষ্টি করেছিলেন। আবার সেই গানেই বলেছিলেন, এই রুপালি গিটার ছেড়ে চলে যাব বহুদুরে।
“এই রুপালি গিটার ফেলে
একদিন চলে যাব দুরে, বহুদূরে
সেদিন অশ্রু তুমি রেখো
গোপন করে।
মনে রেখো তুমি
কত রাত কত দিন
শুনিয়েছি গান আমি, ক্লান্তিবিহীন
অধরে তোমার ফোঁটাতে হাসি
চলে গেছি শুধু
সুর থেকে কত সুরে।”
সত্যিই লিজেন্ড আপনি নিজেই গানে গানে তৈরি করেছিলেন তার যন্ত্রের টুংটাং শব্দ করা এই রুপালি গিটার আর নিজেই হয়েছিলেন এই বাংলাদেশ সহ পুরো উপমহাদেশের গিটারের জাদুকর।
বাংলাদেশের এই কিংবদন্তি যিনি একাধারে ছিলেন গীতিকার, সুরকার, গিটারিস্ট, গায়ক তিনি গত ১৮ই অক্টোবর বৃহস্পতিবার তারঁ অসংখ্য ভক্তদের কাদিয়েঁ ৫৬ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, সকাল ৭টার দিকে মগবাজারের নিজ বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হলে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি সকাল ১০ টার দিকে মারা যান। এই কিংবদন্তী বেশ কিছুদিন ধরেই শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। আর অবশেষে মৃত্যু র কাছে তাকেঁ হার মানতেই হলো।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তিনি মারা যাওয়ার মাত্র কিছুদিন আগে অর্থাৎ ১৬ অক্টোবর রাতে রংপুরে বাংলাদেশ সরকার আয়োজিত উন্নয়ন মেলার একটি কনসার্ট ও করেছিলেন। যেখানে তারঁ একি মঞ্চে অনেক বিদেশী গুনী শিল্পী রাও ছিলেন। আর অনুষ্ঠান টি শেষ করে গত ১৭ ই অক্টোবর দুপুরে ঢাকায় ফিরেন আইয়ুব বাচ্চু। কিন্তু এটিই ছিলো এই গিটার জাদুকরের শেষ অনুষ্ঠান।
কে জানতো, এই অনুষ্ঠানটির পরেই ঘটবে এই কিংবদন্তীর জীবন যবনিকার ছন্দপতন। আসলেই ছন্দপতন ই ঘটেছিলো তারঁ মৃত্যু তে সমগ্র ব্যান্ড সংগীত সহ পুরো বাংলাদেশে। মনে হচ্ছিল সব থমকে গিয়েছে। সব নিস্তব্ধ।। সেদিন বাচ্চা-বুড়ো সব্বার মুখে মুখে শুধু একটি কথা, লিজেন্ড মারা গেছেন, আবার কেউ বা বলছেন রুপালি গিটারের সেই জাদুকর মারা গেছেন।
ঢাকার মগবাজারে তারঁ একটি স্টুডিও রয়েছে। মগবাজারে অবস্থিত এই মিউজিক স্টুডিওটির নাম “এবি কিচেন” ।
পরিশেষে বলবো, রুপালি গিটারের এই গিটার জাদুকরের কথা কিন্তু তারঁ ভক্তরা রাখেন নি।
তিনি নিজেই রুপালি গিটার গানটিতে বলেছিলেন,
“যেদিন তিনি বহুদুরে চলে যাবেন সেদিন যেনো অশ্রু গোপন করে রাখা হয়”।
কিন্তু কেউই কথা রাখেননি। আসলে এই কথা কারো পক্ষেই রাখা সম্ভব নয়। সেদিন পারফর্ম করতে গিয়ে চিৎকার করে কেঁদেছিলেন বাংলাদেশের আরেক ব্যান্ড গুরু জেমস। কেদেঁছিলেন তারঁ সাথে কাজ করা অসংখ্য কলাকুশলী, শিল্পী সহ আরো অনেকেই। কেদেছিঁলেন তারঁ অসংখ্য ভক্ত। তিনি যেনো বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষের পরিবারের লোক ই ছিলেন। তারঁ গান না শুনলে এদেশের মানুষের জানি,ঘুম ই আসতো না। তিনি ই আইয়ুব বাচ্চু কিংবা এবি কিংবা আমাদের প্রিয় রবিন স্যার।।
পুরো বিশ্বের সক্কলের মনে জায়গা নিয়ে আর অনেক অনেক ভালোবাসা নিয়ে যে মাটিতে, যে মায়ের কোলে জন্মেছিলেন সে মাটিতে সেই মায়ের ই কোলে আবারো ফিরে গেলেন এই শ্রেষ্ট মানুষটি। চট্টগ্রামের এনায়েত বাজারের পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এই লিজেন্ড।
ওপারে ভালো থাকবেন লিজেন্ড। চ্যানেল আগামী পরিবারের পক্ষ থেকে রইল বিনম্র শ্রদ্ধা আর অনেক অনেক ভালোবাসা।