শোভন
ঋতুপর্ন ঘোষের জন্মদিন নয় আজ কিন্তু ঋতুপর্ন ঘোষের সিনেমাগুলো দেখার পর ভেবেছিলাম তাকে নিয়ে একটা আর্টিকেল লিখবোই, আজ আলসেমি ঝেড়ে লিখে ফেললাম। মানবিক সম্পর্কের ভাঙ্গন গড়ন,যন্ত্রণা,বিষাদ আর সমসাময়িক সামাজিক বিষয় যার সিনেমার মূল বিষয়বস্তু তিনি হলেন ‘ঋতুপর্ণ ঘোষ’। ঋত্নিক-সত্যজিৎ পরবর্তী সময়ে অন্যতম সেরা ও শক্তিমান বাঙালি পরিচালক হলেন তিনি।
প্রথম সিনেমা পরিচালনা শুরু ‘হিরের আংটি’ দিয়ে যেটি কখনো মুক্তি পায়নি। কিন্তু তার দ্বিতীয় সিনেমা ‘উনিশে এপ্রিল’ যেটি সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’ থেকে অনুপ্রাণিত ছিলো, তা মুক্তি পায় এবং দারূনভাবে প্রশংসিত হয় ও বাণিজ্যিক সাফল্যও লাভ করে। তার সিনেমায় রবীন্দ্রনাথ-সত্যজিতের প্রভাব ঋতুপর্ন ঘোষ সবসময় নিজেই স্বীকার করতেন। সিনেমাটি বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কারও লাভ করে। এভাবেই তার পথচলা শুরু সিনেমা পরিচালনায়। এরপর চোখের বালী, বাড়িওয়ালী,অসুখ, আবহমান, সব চরিত্র কাল্পনিক সহ ১৯ টি সিনেমা পরিচালনা করেছেন।
তার সিনেমাগুলো নারীকেন্দ্রিক ও নারীকুলের ক্ষুদ্র – বৃহৎ অনুভূতির বহি:প্রকাশ বিশেষভাবে ফুটিয়ে তোলে। বিভিন্ন সিনেমাবোদ্ধা ও সমালোচকদের মতে তিনি আসলে নারীদের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারতেন এবং দারুনভাবে সেগুলো চিত্রায়িত করতেও পারতেন। শেষদিকে তিনি যৌনতার স্বাধীনতা ও তার সামাজিক প্রতিকূলতা নিয়ে দূর্দান্ত কাজ করেছেন ‘চিত্রাঙ্গদা’য়। একটা বাঙ্গালি ঘর, ঘরের মেয়ে-ছেলেদের পোষাক আর কথা যেমন কল্পনা করতাম ঠিক সেরকমই দেখতে পেতাম তার সিনেমায়; মেয়েদের কপালে সিঁদুর, পড়নে শাড়ি আর ছেলেদের পাঞ্জাবি। তার সেট ডিজাইনিং, কস্টিউম, আর্ট ডিরেকশন আদর্শ বাঙ্গালিনায়া রুচিবোধের পরিচায়ক। সবাই প্রতিষ্ঠিত ভালো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে সিনেমা বানাতে চান। কিন্তু তিনি প্রায় সময়ই নতুন কিংবা বাণিজ্যিক ধারার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে তাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অভিনয় শিল্পীটি বের করে আনতেন। তার সেরা কাজগুলো ফুটিয়ে তোলতেন।
সারাজীবনে মোট ১৯ টি সিনেমা তৈরী করেছেন যার মধ্যে ১২টিই জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছে। এছাড়াও লোকার্নো, বার্লিনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও পুরস্কার পেয়েছেন। শুধু সিনেমা পরিচালনা করেছেন এমনটিই নয়, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সম্পাদনাও করেছেন। ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত ফিল্ম ম্যাগাজিন ‘আনন্দলোকে’র সম্পাদক ছিলেন। এছাড়াও ২০০৬ থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন ‘সংবাদ প্রতিদিনের’ সম্পাদক।
তিনি বিশ্বাস করতেন লিঙ্গ-নির্ধারণের স্বাধীনতায় আর তাইতো নিজের লিঙ্গ পরিবর্তনের মতো সাহসী এক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় সিনেমা অঙ্গনের হাতেগোনা কয়েকজনের মধ্যে অন্যতম যারা নিজেদের সমকামিতা এবং যৌনতা নির্ধারণে কখনো রাখঢাক পছন্দ করতেন নাহ। তিনি ছিলেন ভারতীয় LGBT আন্দোলনের অন্যতম আইকন। তার এই যৌনতা ও লিঙ্গতার স্বাধীনতার আন্দোলন ও লিঙ্গ পরিবর্তনের ফলে তাকে অনেক জায়গায় অস্বস্তির মুখে পড়তে হয়েছে এবং তাকে তার সমাজ ও পরিবার থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলো। তবুও তিনি লড়াই করে গিয়েছেন এবং একের পর এক সার্জারী নিয়ে গিয়েছেন। অবশেষে মৃত্যুর কাছে হার মেনেছেন ২০১৩ সালের ৩০ মে ৪৯ বছর বয়সে।
একজন সিনেমা পরিচালকের বাইরেও ঋতুপর্ণ ঘোষ ছিলেন একজন সংগ্রামের প্রতীক। যার সংগ্রাম ছিলো স্বাধীনতার;যৌনতা ও লিঙ্গ নির্ধারণের স্বাধীনতা। তিনি চলে গেলেও সিনেমাবোদ্ধাদের মনে গেথে থাকবেন আজীবন।