ইভান পাল
আজ এমন ই একজন মানুষের কথা বলব, যিনি বাংলাদেশের সংগীত জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও একজন সুপ্রতিষ্টিত গায়ক। “লাকি আকন্দ”। জন্মেছিলেন ১৯৫৬ সালের ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, বর্তমানে বাংলাদেশের ঢাকার পাতলা খান লেনে।
তারঁ বয়স টা যখন মাত্র ৫ বছর, তখন ই তিনি তারঁ বাবার কাছ থেকে নেন সংগীতের হাতেখড়ি। আর সেদিন থেকেই যাত্রা শুরু করেন সংগীতের ভুবনে। আপন করে নেন সংগীত কে। আর এরপর থেকেই তিনি টেলিভিশন এবং রেডিওতে নিয়মিত ভাবে শিশু শিল্পী হিসেবে সংগীতের অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নেন।অর্থাৎ আমি ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৭ সালের কথা বলছি।আর পরবর্তীতে তিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সেই এইচএমভি পাকিস্তানের সুরকার হিসেবে পরিচিতি পান।
আবার এর ঠিক দু বছরের মাথায় অর্থাৎ তারঁ বয়স যখন মাত্র ১৬ বছর তখনই তিনি এইচএমভি ভারতের সংগীত পরিচালক হিসেবে নিজের নাম যুক্ত করেন। যা ছিল সত্যি অক্লপনীয়! কেনই বা অক্লপনীয় হবে না। এই মাত্র ষোল বছর বয়স,এতো বাচ্ছা বয়সে এই ছেলে সংগীত পরিচালক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।এযে সত্যি ই অবাক করা ব্যাপার! কেনো হবে না, তিনি যে সংগীতকে ভীষণ ভাবে ভালোবাসতেন।
ক্যালেন্ডারের সালের দিকটায় তখন ১৯৭৫ সাল। লাকী আকন্দ আয়োজন করেন একটি সংগীত আলবামের যেখানে তিনি যুক্ত করেন বাংলাদেশের আরেকজন শ্রেষ্ট শিল্পী, সংগীত, পরিচালক, সুরকার তার ই অনুজ“ শিল্পী হ্যাপি আকন্দ”কে।
এবার একটু শিল্পী হ্যাপি আকন্দ কে নিয়ে বলি—
“ হ্যাপি আকন্দ”।। যাঁকে বলা হত, বাংলাদেশী সঙ্গীতের বরপুত্র। যিনি আর ডি বর্মণ,আববাসউদ্দীন, মান্না দে , সমর দাশের মতো এই উপমহাদেশের বিখ্যাত সব সুরকার, সংগীতজ্ঞদের প্রশংসা আর স্নেহ পেয়েছিলেন নিজ যোগ্যতায়।
হ্যাপি আখন্দের জন্ম হয় ঢাকার পাতলা খান লেনে ১২ অক্টোবর , ১৯৬৩ । আমি আগেই বলেছি হ্যাপি আকন্দ হচ্ছেন লাকী আকন্দের ছোট ভাই।সব থেকে মজার ব্যাপার ছিলো দু ভাইয়ের বয়সের পার্থক্য বেশী হলে ও তারাঁ ছিলেন দুজনে একে অপরের বন্ধুর মতো।।
আচ্ছা প্রিয় পাঠক আপনাদের, “আবার এলো যে সন্ধ্যা” গান টা মনে আছে।
“আবার এলো যে সন্ধ্যা,
শুধু দুজনে।
চলো না ঘুরে আসি অজানাতে,
যেখানে নদী এসে থেমে গেছে”।
আমি জানি অনেকেই হয়তো মনে মনে দুলাইন গেয়ে ও ফেলেছেন। কিংবা আরো একটি জনপ্রিয় গান আছে।
“কে বাশি বাজায় রে
মন কেন নাচায় রে
আমার প্রান যে মানে না
কিছুই ভালো লাগে না”।
অথবা আমাদের কাছে আরো একটি গান যেটা আমরা ফোক সং হিসেবে বলে থাকি,
“ইস্কুল খুইল্লা ছেড়ে মওলা”।
পাঠক মহল হয়ত মনে মনেই ভাবছেন শুধু শুধু এই গান গুলোর কথা কেন বলছি। কারণ, একটি ই।এই গান গুলো কিন্তু হ্যাপি আকন্দের ই গাওয়া গান। তবে তারঁ গানের ঝুড়িতে আরো গান রয়েছে।উপরের যে গানগুলোর কথা বললাম, তা আজ ও এতটাই জনপ্রিয় যে মানুষের মুখে আজো এই গান গুলো শোনা যায়।
জন্মেছিলেন সংগীত পরিবারে যার ফলশ্রুতি তে বাবা এবং বড় ভাই লাকী আখন্দের কাছ থেকে পেয়েছেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতজ্ঞান, আবেশী কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সঙ্গে গিটার , পিয়ানো বাজাতে পারতেন।সাথে আবার ক্ল্যাসিকেল ইন্সট্রুমেন্ট তবলা সহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর ক্ষেত্রে তারঁ ছিল অসাধারণ খেল। যা বিস্মিত করেছিল তখনকার শ্রোতা ও শিল্পীদের। বললাম তো, তিনি এমন ই একজন শিল্পী ছিলেন যারঁ হাতে মাত্র ১০বছর বয়সেই গিটারের তাল ধরা দেয়।।
আবার তারঁ “আবার এলো যে সন্ধ্যা” গান টি ঘুড্ডি চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়। তবে এই আবার এলো যে সন্ধ্যা গানটির সংগীত পরিচালনা করেন তাঁর ই অগ্রজ লাকী আকন্দ।
যাক, হ্যাপি আকন্দ কে নিয়ে এত কথা বলেছি কারণ ছিল একটি ই, হ্যাপি আকন্দ ছিলেন লাকী আকন্দের কাছে নয়নের মনি। সবসময় যাই করতেন, দু ভাই একসাথেই করতেন। ব্যান্ড করেছিলেন, “হ্যাপি টাচ”। তাতেও দু ভাই একসাথে। কেউ বাজাতেন, কেউবা গাইতেন। হ্যাপি আকন্দ ২৮শে ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে খুব অল্প বয়সেই মারা যান।লাকী আকন্দ ভাইকে এত টাই ভালোবাসতেন যে, যখন হ্যাপি আকন্দ মারা গেলেন তখন তিনি শোকে এতটাই মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন যে– তারঁ ভালবাসার এই সংগীত জীবনে তিনি দীর্ঘ সময় বিরতিতে চলে যান।
পরবর্তীতে এই শোক কাটিয়ে প্রায় ১যুগ পর ফেরেন তারঁ ভালোবাসা আর ভাল লাগার এই সংগীত জীবনে।
১৯৯৮ সালে “পরিচয় কবে হবে”ও “বিতৃষ্ণা জীবনে আমার” অ্যালবামের সঙ্গীতায়োজন করেন। “পরিচয় কবে হবে” ছিল তাঁর দ্বিতীয় একক অ্যালবাম। তবে এটি ছিল হ্যাপী আখন্দের একক অ্যালবাম শেষ উপহার এর রিমেক।
“বিতৃষ্ণা জীবনে আমার” ছিল ব্যান্ড ও আধুনিক গানের মিশ্র অ্যালবাম। এতে বাংলাদেশের সেসময়ের তো বটেই, বর্তমান সময়ের ও খ্যাতিমান ক’জন জনপ্রিয় গায়ক কন্ঠ দিয়েছিলেন। আর তারাঁ হলেন — মাহফুজ আনাম জেমস , আইয়ুব বাচ্চু, হাসান , কুমার বিশ্বজিৎ , তপন চৌধুরী , ও সামিনা চৌধুরী ।
ঐএকই বছর তিনি সামিনা চৌধুরীকে নিয়ে “আনন্দ চোখ” নামে একটি দ্বৈত অ্যালবাম প্রকাশ করেন। শিল্পী গোলাম মোরশেদের কন্ঠে এবং লাকী আখান্দের সঙ্গীতায়োজনে অ্যালবামটি প্রকাশ করে সাউন্ডটেক। যেখানে ছিল ১২টি গান, আবার যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গান ছিল– “কাল কি যে দিন ছিল”, “বলো কে পারে” ও “এই বরষা রাতে”। তিনি বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড আর্ক এর “হৃদয়ের দুর্দিনে যাচ্ছে খরা” গানের সুর করেন।
২০০০ সালের পর আবারো তিনি আরেকটি মিশ্র অ্যালবামের কাজ করেন।”তোমার অরণ্যে”। এতে তিনি অ্যালবামটির সুর ও সঙ্গীতায়োজন করেন। আবার এই অ্যালবামেই লাকী আখান্দের কণ্ঠে গাওয়া ৩টি গানসহ বাপ্পা মজুমদার , ফাহমিদা নবী , ও নিপুর কণ্ঠে ১০টি গান ছিল। তিনি এই অ্যালবামটিতে ই ব্যবহার করেন সমকালীন তাল, লোক গানের তাল। তিনি স্পেনীয় গানের ভক্ত ছিলেন।আর এই অ্যালবাম ই তিনি তার প্রিয় স্পেনীয় গানের তাল ব্যবহার করেন।
তারঁ অ্যালবামটি সমূহ হচ্ছে — পরিচয় কবে হবে, বিতৃষ্ণা জীবনে আমার, আনন্দ চোখ,আমায় ডেকোনা, দেখা হবে বন্ধু,তোমার অরণ্যে।।
লাকী আকন্দ দেশ টিভি তে কোন এক অনুষ্ঠানে “তুমি কে বলো না” গানটি করতে গিয়ে বলেছিলেন, “তারঁ মা চাইতেন তিনি যেন ক্ল্যাসিকেল বেস কিছু গান করেন। মর্ডাণ মিউজিক দিয়ে ব্ল্যান্ড করে কিছু করেন। ঠুমরি,ভজন এরকম কিছু।
আর তারপর তিনি ক্ল্যাসিকেল বেস গান করতে গিয়ে করেন সেই বিখ্যাত, “তুমি কে বল না” গান টি। যেখানে কিছুটা পন্ডিত অজয় চক্রবর্ত্তীর ফ্লেভার আছে। তো এই গান টি শুনে তারঁ মা তাকেঁ ভালবেসে ১০০০০টাকা দিয়েছিলেন। আসলে, তিনি ই বলেছিলেন যে আমি তো আমার জীবনের সেরা ১টি গান করলাম। তো, একথা শুনে তারঁ মা বলেছিলন, ঠিক আছে তুমি তোমার জীবনের সেরা ১টি গান করেছ তো এই নাও তোমার উপহার।তখন ই তারঁ মা তাকেঁ ১০০০০টাকা উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন।”
ভারতের বিখ্যাত শিল্পী, সুরকার, সংগীত পরিচালক এবং চলচ্চিত্র পরিচালক অঞ্জন দত্ত একবার ১৯৯৮ সালের দিকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন তিনি লিখেছিলেন “১৯৯৮ এর এপ্রিল মাস নাগাদ আমি প্রথম বাংলাদেশ যাই, গান গাইতে। ঢাকার ন্যাশনাল মিউজিয়াম অডিটরিয়ামে আমাদের শো। প্রথমবার ঢাকা, হল ভর্তি শ্রোতা, দারুণ লাগছে। হঠাৎ শো’এর মাঝামাঝি আমাদের জলসার উদ্যাক্তা নিমা রহমান আমায় জানান, হলে একজন শিল্পী উপস্থিত, যিনি একসময় খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তাকে আমি চিনিনা, তার গানও কখনও শুনিনি। কিন্তু একেবারেই নিছক আসর জমানোর উদ্দেশ্যে হঠাৎ তাকে মঞ্চে আসতে আহ্বান করলাম। তিনিও দিব্যি উঠে এলেন এবং আমার সাথে গান বাজনা করতে শুরু করে দিলেন। যদিও তাকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার কোন গানটা গাইবো বলুনতো? তিনি বলেছিলেন, আমার গান তিনি আদৌ শুনেননি। দিব্যি গান গাওয়া হলো, আসর জমে গেল। বহু বছর যে শিল্পী গান গাওয়া বন্ধ করে চুপ মেরে বসেছিলেন হঠাৎ আবার গান গেয়ে উঠলেন। তারপর তার সঙ্গে তেমন ভাবে আর কোন যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু যে কারণে এইসব কথাগুলো বলছি, তা হলো জীবনে খুব কমই আমি অন্য কোন শিল্পীর সঙ্গে গান গাইতে গিয়ে এতটা এনজয় করেছি। তাই ভাবলাম, গল্পটা আপনাদের বলি।
আবার অঞ্জন দত্ত কিন্তু এই গল্পের উপর গান ও লিখেছিলেন।
“দু’জনে থাকে দুটো দেশে
দুজনেই গান বেচে খায়
গানে গানে কোন এক মঞ্চে
হঠাৎ দেখা হয়ে যায়
একজন বাজায় গীটার
আরেকজন কীবোর্ডস
একজন গান গেয়ে চলে
আরেকজন দেয় সঙ্গ
মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় গান
সেদিনের সেই জলসায়
একাকার হয়ে যায় ঠিকানা
কলকাতা কিংবা ঢাকায়।। ”
লাকী আকন্দ ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানী আর্ট কাউন্সিল হতে “বাংলা আধুনিক গান” বিভাগে পদক লাভ করেছিলেন। তাঁর নিজের সুর করা গানের সংখ্যা তাঁর কথায় দেড় হাজারেরও বেশি।।
লাকী আখন্দ দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুস ক্যান্সারে ভুগছিলেন। ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল তিনি নিজের আর্মানিটোলার বাসাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাকেঁ আর ফেরানো গেলো না।। নিজেই বলেছিলেন নিজের গানে–
আমায় ডেকো না
ফেরানো যাবে না
ফেরারী পাখিরা
কুলায় ফেরে না।।
হয়তোবা কোন এক অভিমানের বশেই গান টি গেয়েছিলেন। সত্যি ই এই শ্রেষ্ট শিল্পী কে আর ফেরানো গেল না। পাড়ি জমিয়েছিলেন না ফেরার দেশে।।আর তারঁ সেই অমর সৃষ্টি গুলো আজো মানুষ কিন্তু শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে।
আগে যদি জানতাম কিংবা মামুনিয়া কিংবা আবার এলো যে সন্ধ্যা’র মতো গান গুলো আজো মানুষের মুখে মুখে।
শ্রেষ্ঠ এই সংগীতজ্ঞের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য