শাকিলুর রহমান
সময়টা ছিল ব্রিটিশ ভারতের শেষের দিকে রয়াল এয়ারফোর্সে ছোট একটা চাকুরীর সুবাদে একদিন এক বৈমানিক বলল, তোমার ধুতি পাঞ্জাবীটা পরে একটা ছবি তুলতে চাই, আর ছবিটা তুলবে তুমি বলে, তার ১২৭ বেবী ব্রাউনি ক্যামেরাটা তুলে দিল ১৬ বছরের এক উদ্দাম যুবকের হাতে, কোন ইংরেজ সাহেবকে সরাসরি না বলার দঃসাহস কোন বাঙ্গালীর ছিলনা অথচ দৃঢ় চেতা যুবকটি বিনয়ের সাথে বলল “আমি আমার ধুতি পাঞ্জাবী দিতে পারি কিন্তু ক্যামেরা চালাতে জানিনা। বৈমানিক তাকে ক্যামেরা চালানের কৌশল শিখিয়ে দিলেন। যুবকটি আত্মবিশ্বাসের সাথে চমৎকার ছবি তুলল। তখনকার এনালগ ক্যামেরায় সাদা কাালো ছবি তোলার জন্য ক্রিটিক্যাল শার্পনেস ও ভালো কম্পোজিশন ছিল অত্যন্ত জরুরী। কিন্তু প্রথম ক্যামেরা হাতে মোঃ লৎফর রহমান কে অপরিচিত কিবা আনকোরা ফটোগ্রাফার মনে হয়নি যার প্রমান তার কাজের মুন্সীযানায় তিনি দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তিনি ফটোগ্রাফিক নিজের ধ্যান ও জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্থানে ধারণ করে কিনেফেলেন ১২০ আগফা বক্স ক্যামেরা।

এসময় তিনি রাজশাহী শহরে অবস্থান করেন এবং একই সাথে স্টুডিও ফটোগ্রাফি ও প্রেস ফটো কাভারেজের কাজ করে প্রশংসিত হন। অসহায় গরীব ছাত্রদের কাছ থেকে তিনি ছবির বিনিময়ে কোন পয়সা নিতেন না। রাজশাহী শহরে কিবা উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বড় কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক সভা হলেই ডাক পড়তো লুৎফর রহমানের। ষাটের দশকের প্রথমার্ধেই তিনি রাজশাহীর বিশিষ্ঠ নাগরিকদের সান্নিধ্যে আসেন। তারা রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। উত্তর বঙ্গের এই সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের প্রতিষ্ঠাকালিন দূর্লভ সব ছবির কারিগর ছিলেন এই প্রতিথযশা আলোকচিত্র শিল্পী। ১৯৫৪ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রাজশাহী সফরে এসে প্রথম বারের মত লুৎফর রহমানএর ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দী হন।এভাবেই বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসের একেকটি কালজয়ী মহুর্ত গুলো চিত্রিত করতে থাকেন এই গুনিী শিল্পী, বঙ্গালীর অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলন,সংগ্রামে গর্জে উঠেছে তার ক্যামেরা ফ্লাশ।

ছয়দফা আন্দোলনের পর লুৎফর রহমানের ভাবনায় আসে জাতীয় পর্যায়ের সকল ঘটনাকে তিনি চিত্রিত করবেন। এ মানস থেকে তিনি রাজশাহী থেকে ঢাকায় চলে আসেন। বঙ্গবন্ধুর তোলা ছবিগুলো নিয়ে সরাসরি হাজির হন বাঙ্গালীর স্বাধীনতা, স্বকয়িতা রচনার লেখক জাতির পিতার সামনে। বঙ্গবন্ধু সেদিন খুব খুশি হয়েছিলেন আর বলেছিলেন চালিয়ে যেতে। এরপরে চালিয়ে গেলেন লুৎফর রহমান তার ক্যামেরা। ৬৯-এর গণঅভ’ত্থান,৭০ এর নির্বাচন,৭ই মার্চ ১৯৭১ এ ঐতিহাসিক ভাষন, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান,৭২ বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরা, অনেক দুর্লভ ঐতিহাসিক ছবি তুলে নিজেও ইতিহাসের অংশে হয়ে গেছেন এই ক্যামেরাম্যান। ১৯৭২ সালে ৫ টাকা ১০টাকার নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি সংযোজনর জন্য যে চিত্র গ্রহন করা হয়েছিল তাতে লৎফর রহমান স্মরনীয় হয়ে থাকবেন। ৩২ নং ধানমন্ডির বাড়িতে তোলা বঙ্গবন্ধুর ছবিটি শোভা পাচ্ছে এই মুদ্রাগুলোতে। বঙ্গবন্ধুর সাথে সাথে অন্যান্য জাতীয় নেতৃবৃন্দ মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক সংগঠকদেরও ছবি তুলেছেন এই গুনী শিল্পী। এই মুদ্রগুলি মিরপুরের ঢাকা জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে। ১৯৭২ সালের ২৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ইউইলকিনশন কোম্পানির পক্ষ থেকে ইয়াসিকা ম্যাট ১২৪ জি ক্যামেরা তৎকালিন হোটেলে ইন্টার কন্টিনেন্টাল আলোকচিত্রির কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। কোম্পানিটির কর্মকর্র্তাবৃন্দ সে সময় ৫ ও ১০ টাকার এক খন্ডের টাকাও তাকে উপহার দেয়া হয়। তার সৃষ্টি কমূগুলো এখনো উজ্জল হয়ে শোভা পাচ্ছে। ৩২ নং ধনিমন্ডিরস্থ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘ।বাংলাদেশ সচিবালয়ের তথ্য মন্ত্রনালয়ের ব্যালকনিতে। তিনি রেডিও পাকিস্থান এর মুখপাত্র “এলহান ম্যাগাজিনে কাজ করতেন। দেশ স্বাধীনের পরে বাংলাদেশ বেতারের, বেতার বাংলায় তার তোলা অনেক ছবি ছাপা হয়েছে।

সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রের অনেক খ্যাতিমান তারকাদের ছবি তুলেছেন এর মধ্যে হেমন্ত মখোপ্যাধ্যায়,রুনা লায়লা মেহেদী হাসান আব্দুল আলিম, ফেরদৌসী রহমান অন্যতম। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও অনেক ছবি তুলেছেন এই শিল্পী। শুধু ক্যামেরা হাতেই নয় কলম হাতেও সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু কে নিবেদন করে লিখেছেন কবিতা“চিরঞ্জীব”। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু খুশি হয়ে তাকে ম্যাট-১২৪ জি ক্যামেরা উপহার দেন। তার লেখা প্রবন্ধ শতাব্দীর শ্রেষ্ট মহানায়ক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সচিত্র বাংলাদেশ সহ অনেক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সদা হাস্বোৎজ্জল, বিনয়ী, সৎ, এই মানুষটি অজীবন দেশের জন্য কাজ করেছেন, নির্লোভ থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় ছুটে বেরিয়েছেন দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে জীবনের ঝুকি নিয়ে তিনি পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। ২০০৬ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন এই শিল্পী।

জীবদ্দশায় কখনো কোন অন্যায়,অসত্য ও সুবিধাবাদের সাথে আপোষ করেননি।ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী, এক পুত্র ও তিন কণ্যার জনক ছিলেন। তার সকল সৃষ্টি কর্ম যেন বাংলাদেশের ইতিহাস ও মহাখালীতে তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিচ্ছবি ফটো স্টুডিওটি যেন বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ধারন করা আর্কাইভ। বঙ্গবন্ধু ইতিাহস তৈরী করেছেন আর তার নির্দেশে ইতিহাসের সচিত্র উপস্থাপনার কারিগর ছিলেন আলোক চিত্রশিল্পী মোঃ লৎফর রহমান। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এই অসাধারন কাজগুলো নতুন মত্রা এনেছে এবং তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে অনেকে মনে করেন এবং রাষ্টীয় স্বৃকৃতীর জন্য তিনি তার উপযুক্ততা প্রমান করেছেন এখন আপেক্ষা স্বীকৃতির এই প্রত্যাশা পরিবারের সদস্যদের। ব্যক্তিগত জীবনে হাসিখুশী সদালাপী লুৎফর রহমান ১ পুত্র এবং তিন কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। তার পুত্র মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু দেশের বিশিষ্ট আলোকচিত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এক কন্যা অস্ট্রেলিয়াতে আছেন। বাকী দু’জনকে প্রতিষ্ঠিত ঘরে বিয়ে দিয়েছেন। প্রখ্যাত এই আলোকচিত্রী ২০০৬ সালে মারা যান।
