বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী বছরান্তের চৈত্র মাসের শেষ দিনটিকে বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি। স্বাভাবিক ভাবেই শেষ দিনটি হয়ে থাকে ৩০শে চৈত্র। বাংলা একাডেমির বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বছরের প্রথম পাঁচ মাস অর্থাৎ বৈশাখ থেকে ভাদ্র গণনা করা হয় ৩১ দিনে। আর বাকি ৭ মাস গণনা করা হয় ৩০ দিনে। সেই হিসেব অনুযায়ী ৩০শে চৈত্রই হল চৈত্র সংক্রান্তি। যদিও ভারতীয় পঞ্জিকা প্রণেতাগণের পুরাতন হিসাবের সাথে দিনটির তারতম্য হয়, আবার কখনও কখনও মিলেও যায়।২০০৮ সালে এমনটি ঘটেছে।
চৈত্র সংক্রান্তি মূলত বর্ষ বিদায়ের সাংস্কৃতিক রেওয়াজের আয়োজন। আর যে চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে বাঙ্গালির এত আয়োজন, সেই চৈত্রের আদি ইতিহাস টা অত্যন্ত চমকপ্রদ। চৈত্র মাসের নামকরণ করা হয়েছে ‘চিত্রা’ নক্ষত্রের নামানুসারে। আদি গ্রন্থ পুরাণে, সাতাশটি নক্ষত্রের নামকরনের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যেগুলো রাজা দক্ষের সাতাশজন সুন্দরী কন্যার নামানুযায়ী নামকরণ করা। আর চিত্রা নক্ষত্রটি সেই রাজার এক কন্যা চিত্রার নামে রাখা হয়েছিল। চৈত্র সংক্রান্তির অন্যতম আকর্ষন গাজন। গাজন একটি লোক উৎসব। চৈত্র সংক্রান্তি থেকে শুরু করে আষাঢ়ি পূর্ণিমা পর্যন্ত সংক্রান্তি তিথিতে এই উৎসবটি উদযাপিত হবার কথা। কিন্তু বাস্তবিক কেবলমাত্র ৩০শে চৈত্রতেই এ উৎসবের আমেজ বিশেষভাবে চোখে পড়ে।
চৈত্র সংক্রান্তির প্রধান আকর্ষণ চড়ক। চড়ক গাজন উৎসবেরই একটি প্রধান অংশ। গ্রামে গ্রামে চড়কের মেলা এখনও চোখে পড়ে। যদিও সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে এটি অনেকাংশে কমে গেছে। চড়কের মেলাতে একজন শিব ও একজন গৌরী সেজে নৃত্য করে এবং অন্যরা বিভিন্ন সাজে সেজে তাদের অনুসরণ করে। এই মেলাতে সাধারণত শূলফোঁড়া, বানফোঁড়া ও বড়শি গাঁথা অবস্থায় চড়কগাছে ঘোড়ানো, আগুনের উপর দিয়ে হাঁটা সহ বিভিন্ন কষ্টসাধ্য শারীরিক কলাকৌশল দেখানো হয়। এ মেলায় বাঁশ, বেত, প্লাষ্টিক, মাটি ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের খেলনা ও তৈজসপত্র, ফল-মূল ও মিষ্টি জাতীয় খাবারের অস্থায়ী দোকানের পশরা বসে। অঞ্চলভেদে এ মেলা দু-তিন দিন স্থায়ী হয়। এতো গেল চৈত্র সংক্রান্তির কথা।
বাঙ্গালী যেদিন চৈত্র সংক্রান্তি পালন করে সেদিন আদিবাসী সম্প্রদায় পালন করে তাদের নিজস্ব বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান-বৈসাবি। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান উপজাতিদের মধ্যে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা উপজাতি এ উৎসব উপলক্ষ্যে যথাক্রমে বিষু, সাংগ্রাই ও বৈসুক নামক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ঐ অনুষ্ঠান তিনটির নামের আদ্যাক্ষরের সমন্বয়ে বৈসাবি উৎসবের নামকরণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে ওরা বাড়ি-ঘর থেকে শুরু করে মন্দির সাজায়। কলাপিঠা, সান্যাপিঠা, বিন্নিপিঠা এবং বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি ও পানীয় দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করে। বর্ষ বরণ অনুষ্ঠান বাঙ্গালী কিংবা আদিবাসী যেই হোকনা কেন সবার কাছে একটি উৎসবের ও আনন্দের আয়োজনে পরিণত হয়েছে। চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে গ্রাম কিংবা শহর, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মেতে উঠে উল্লাসে।
ছবিঃ লেখক।
আসীর মুরাদ