~ নাহিদ আহসান ||
মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করেই দুজন নিরাপত্তারক্ষীর কড়া নজরদারীর ভেতর দিয়ে এবং সিকিউরিটি মেটাল ডিটেক্টর মেশিনের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করার পরই অনুমতি মেলে এখানে ঢোকার। প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢোকার পর বামপাশে একটু তাকালেই চোখ চলে যাবে বিশাল এক মানচিত্রের দিকে, বিশাল সুন্দর গাম্ভীর্যপূর্ণ এক মানচিত্র, আমাদের বাংলাদেশের, আমাদের মাতৃভূমির। তারপর একটু সামনে এগোলেই বিশাল এক দেয়ালচিত্র, যেখানে গাঁথা আছে যেন দেশের ইতিহাস। ডানপাশে বিশাল ফুলের বাগান। এদিকে ভাগ হয় মূল রাস্তা, হয়ে যায় দুটি প্রবেশপথ। একটি সোজা, অপরটি ডানে, ডান বরাবর এগোলেই বঙ্গবন্ধুর বিশাল দেয়ালচিত্র। মাঝেমধ্যে হুট করে তাকালে যেন মনে হয় এখানে স্বয়ং বঙ্গবন্ধুই চলে এসেছেন। তারপর মূল দালানে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে প্রয়াত শিল্পপতি গুল মোহাম্মদ আদমজীর দেয়ালচিত্র।
এতক্ষণ যা পড়লেন, তা আর অন্য কোনো স্থান নয়, এটি হচ্ছে সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত দেশের অন্যতম সেরা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং হাজারও শিক্ষার্থীর স্বপ্নের ‘আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ’। দেশসেরা এই কলেজটি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে অবস্থিত। সবুজে ঘিরে থাকা অন্যরকম এক মনোরম পরিবেশ এবং এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার স্বপ্ন শিক্ষার্থীদের থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। চলুন, পরপর তিনবার সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সেরা নির্বাচিত হওয়া এবং গতবার ঢাকা মহানগরীর শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত হওয়া এই কলেজ সম্পর্কে আরও বিশদভাবে জেনে আসা যাক।
সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত এই আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজটি মূলত স্কুল হিসেবে ১৯৬০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক ভাবে যাত্রা শুরু করে, যা সেনাবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে এবং প্রয়াত শিল্পপতি গুল মোহাম্মাদ আদমজীর অর্থায়নে ইংল্যান্ডের আদি পাবলিক স্কুল “ইটন” ও “হ্যারো”-র আদর্শে প্রতিষ্ঠিত হয়। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ভবনটি নির্মিত হয় বিশিষ্ট স্থপতি থারিয়ানির নকশায় এবং ভবনটি নির্মান করেন ওমর এন্ড সন্স লিমিটেড। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান এই প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন এবং সেনাবাহিনীর তৎকালীন ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসিকে প্রধান করে বোর্ড অফ গভর্নরস গঠন করা হয়। এই কলেজটির প্রথম দুজন অধ্যক্ষ ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক। যার ফলে স্বাধীনতার পূর্বে এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাদানের মাধ্যম ছিল ইংরেজি। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার মাধ্যম হয় বাংলা।
১৯৯৫ সালে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ শাখাকে স্কুল শাখা থেকে আলাদা করা হয়। কলেজটির তিনটি মূলমন্ত্র রয়েছে, যা হলো – শিক্ষা, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা, প্রশাসনিক ভবনের দেয়ালের উপর যেন বড্ড বড় বড় অক্ষরে খচিত আছে এই মূলমন্ত্র। যেন প্রতিবার সকালের এসেম্বলিতে শিক্ষার্থীদের চোখ পড়ে এই মূলমন্ত্রের দিকে এবং শিক্ষার্থীরা যেন সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, শৃঙখলা ও নৈতিকতাকে মূলমন্ত্র ধরে গঠন করে এক সুন্দর জীবন। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে রয়েছে পাঁচতলা বিশিষ্ট বিজ্ঞানভবন, সুউচ্চ বিবিএ ভবন, অনার্স-মাস্টার্সের জন্য মাস্টার্স বিল্ডিং, লাইব্রেরী ভবন এবং প্রশাসনিক ভবন।
কলেজে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক শাখার পাশাপাশি অনার্স, মাস্টার্স ও বিবিএ কোর্সও চালু আছে। কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত জীবনে কর্মশীল এবং বিভিন্ন কাজে দক্ষ করে তোলার জন্য এবং বিভিন্নভাবে নিজেদের দক্ষতার চর্চা করার জন্য রয়েছে বিভিন্ন ক্লাব, যাদের কর্মকান্ডে উপকৃত হয় হাজারও শিক্ষার্থী।
আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের বিশাল খেলার মাঠ এবং আরও একটি সুন্দর ছোট মাঠ রয়েছে, তা যেন গ্রামের বাড়ির সুন্দর উঠানের মতোন প্রশাসনিক ভবন এবং লাইব্রেরী ভবনের সামনে রয়েছে সবুজে আচ্ছাদিত হয়ে। সকাল হলে যেমন গ্রামের বাড়ির উঠানে বসে গল্পরাজ্যের ডানামেলে আড্ডা, তেমনই ক্লাস শেষে যেন এই সুন্দর ঘাসে মোড়া উঠানেও বসে শিক্ষার্থীদের আড্ডার পসরা। কোথাও গল্প হয় ক্লাসে কি পড়ানো হয়েছে তা নিয়ে, কোথাও স্যার-ম্যাডামের বকা খাওয়া নিয়ে, কোথাও পরীক্ষা নিয়ে কোথাওবা চলে বন্ধু-বান্ধবদের হাজারও খুনসুটি। লাইব্রেরী বিল্ডিং এর নীচে অবস্থিত অত্যন্ত সুন্দর লাইব্রেরীতে রয়েছে যেন লক্ষাধিক বই, সেখানেও বসে বই পড়ুয়াদের বিশাল আড্ডা। এই কলেজের ছোট মাঠ-বড় মাঠের মাঝে, বিজ্ঞান ভবন থেকে বিবিএ ভবনে যাওয়ার পথে পড়ে কাষ্ঠল বৃক্ষরাজির সুন্দর এক বাগান, যেখানে সুসজ্জিত আছে বেশ কয়েকজোড়া বসার বেঞ্চ। প্রচন্ড রোদ্দুরের মাঝেও ছায়াঘেরা বিশাল এই জায়গাটিতেও বসে শিক্ষার্থীদের আড্ডা। বিবিএ ভবনের সামনে রয়েছে প্রয়াত শহীদ রুমির স্মরণে নির্মিত রুমি মঞ্চ। যেই মঞ্চে জড়িয়ে থাকে হাজারো শিক্ষার্থীর কতোশতো স্মৃতি।
পুরোটা ক্যাম্পাস জুড়েই যেন বিশাল বিশাল গাছের সমারোহ, যা ঘিরে রাখে পুরো ক্যাম্পাসটাকে সবুজ ছায়া দিয়ে। বিজ্ঞান ভবনের পাশে বাস্কেটবল খেলার মাঠ, তার পাশে ছোট্ট পুকুর। বড়মাঠ আর বাস্কেটবল খেলার মাঠের মাঝ দিয়ে ক্যান্টিনে যাওয়ার পথ, টিফিনের ঘন্টা পড়লেই যেখানে ভীড় জমে সকল ছাত্রছাত্রীদের। কলেজটিতে রয়েছে নামাজ পড়ার জন্য সুন্দর এক মসজিদ, যেখানে ছাত্রশিক্ষক সকলেই কাতারবদ্ধ হয়ে আদায় করে সালাত, দো’আ করে কতোকিছুর জন্য। সবুজে মোড়ানো এ ক্যাম্পাসটায় যেন সবসময় ই পাখির কলকাকলি চোখে পড়ে, দেশের ছয়টি ঋতুও যেন আপনি সুন্দর মতোন অনুভব করতে পারবেন মনোরম এই ক্যাম্পাসে বসে। সকালবেলা ক্লাস করতে করতে হঠাৎ দেখবেন বকুল ফুলের প্রচন্ড রকমের ঘ্রাণ আসছে বারান্দা দিয়ে, ক্লাস শেষ করে বারান্দায় গেলেই দেখবেন, গাছভর্তি বকুলফুল ফুটেছে। নীচে নামলেই যেন পথে আর পা ফেলার জায়গা নেই, সারাপথ জুড়ে আছে বকুল ফুল। কখনোবা দেখবেন কেউ হয়তো কারোর জন্য কুড়িয়ে নিচ্ছে এই প্রিয় ফুল, হয়ত রেখে দিবে নিজের কাছেই, বেশ যতনে।
প্রচন্ড ব্যস্ত এ নগরীতে, প্রচন্ড কোলাহলময়, ধুলায় আচ্ছন্ন চারপাশ পেড়িয়ে এসে সুবিশাল এই আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ক্যাম্পাসে যখন কেউ পা রাখে, বুকপকেটের উপর আদমজীর লোগো নিয়ে, তার স্বপ্ন যেন সত্যি হয়ে উঠে বাস্তবের মাঝেই। অচেনা, অজানা, কখনো না আসা এই ক্যাম্পাস হয়ে উঠে একেকজনের প্রিয় জায়গা, ভালোলাগার জায়গা, মনখারাপের জায়গা। পড়াশুনা করতে করতে এই সবুজের ভীড়ে কখন যে পড়াশুনার সময়ও শেষ হয়ে আসে, সে কথা আর কাউকে বলা হয়ে উঠে না। কোনো একদিন র্যাগ ডে’র ঘোষণা আসে। কোনো একদিন বিদায়ী অনুষ্ঠান হয়। উদাস মন নিয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ভেজা চোখ নিয়ে ছুটে চলে এই স্যারের নিকট, এই ম্যাডামের নিকট। একটু দো’আ চেয়ে আসা যাক, কতোই না জ্বালানো হয়েছে তাদের, আবার কবে ই বা আসা হবে এই প্রিয় স্থানে। তারপর একে একে বের হতে থাকে মূল ফটক দিয়ে।
বের হবার সময় মূল ফটকের উপরে একদম বড় করে লেখা দেখতে পায়, ‘এসো জ্ঞানের সন্ধানে, ফিরে যাও দেশের সেবায়।’
মনের অজান্তেই বুকপকেটের নীচে আলতো ব্যাথা অনুভূত হয়, এইত সেদিন না জ্ঞানের সন্ধানে এলাম এখানে, দেশের সেবা করার জন্য ফিরে যাওয়ার সময় তো হয়ে উঠেছে, এতোই জলদি। শেষবারের মতো প্রবেশদ্বারে থাকা নিরাপত্তারক্ষীকে একটু জড়িয়ে ধরে কেউ কেউ। হোক না এই মনখারাপের, সকলেই ভাগীদার।
–
নাহিদ আহসান
ব্যাচ’১৮
আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ।