–জুবায়ের ইবনে কামাল
জীবনধারণের জন্য একটা শিশু শহরে পাড়ি জমালো। তাকে একটা প্রতিষ্ঠান কাজ দেবার কথা বলে নিয়ে গেলো। সে প্রথম প্রথম তার বয়স অনুযায়ী ছোটখাটো কাজ করতো। সেই শিশুশ্রমিককে একবার ইট ভাঙতে বলা হলো। সে কখনো এটা করেনি। তবুও অনেক কষ্টে সে এটা করতে থাকলো। কিছুদিন পর হঠাৎ তাকে ইটের সাথে পাথরও ভাঙতে বলা হলো। তার প্রতিবাদ কতৃপক্ষের কাছে কোন মূল্যবান ছিলোনা। কিছুদিন যেতে না যেতেই তারা বাচ্চাটির সাথে খেলা শুরু করলো। এবার তার কাজের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়া হলো। তার ভবিষ্যৎ ছিলো শুধু ইট আর পাথর ভাঙ্গার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
উপরের গল্পটা হাস্যকর এবং অবাস্তব। এইসব গল্প থেকে কিছু শেখাও যায়না। তারচে বরং শেখা বিষয়ক কিছু কথাবার্তা বলা যাক। বাংলাদেশ নামক একটি দেশে তাদের শিক্ষাবোর্ড চিন্তা করলো বাচ্চাদের সৃজনশীল মেধা কিভাবে বাড়ানো যায়। তারা হঠাৎ করেই স্কুল শিক্ষার্থীদের “সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি” নামে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করলো। সে তো ঝামেলার শেষ নেই। শিক্ষকরা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো এ আবার কি জিনিস! যাক তবুও চলছে। ২০১০ সালে ক্লাস ফাইভে আর এইটে একটি বোর্ড পরীক্ষা চালু করা হলো। যেখানে দশ বছর পড়ে ম্যাট্রিকের সময় ছেলে মেয়েদের হাত কাঁপে সেখানে ফাইভে পড়ুয়া কোমলমতি শিশুরা দেবে বোর্ড পরীক্ষা! যাক ইট আর পাথর ভাঙ্গা একই জিনিস। শিক্ষকদের সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝবার আগেই ২০১৬ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমসিকিই প্রশ্নের মান কমিয়ে দুটো সৃজনশীল বৃদ্ধি করা হলো। মোট সৃজনশীল প্রশ্ন লিখবে সাতটি। পরীক্ষার সময় বাড়ানো হলোনা। আরে আরে উতলা হচ্ছেন কেন! এখনো শেষ হয়নি তো।
আচ্ছা আজেবাজে কথা শুনে রাগ লাগছে? তাহলে বরং পরীক্ষার কথা থাকুক। একটু শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে বলা যাক। আমি বড় নামীদামী স্কুল-কলেজে পড়িনি। পড়েছি মাদ্রাসায়। এখানে ক্লাস এইটেই চার বার সিলেবাস পরিবর্তন করা হয়। ক্লাস টু তে পড়ুয়া বাচ্চাটি ভারী ব্যাগ কাধে নিয়ে কোচিং-ক্লাস দৌড়াতে দৌড়াতে খেলার সময় দূরে থাক একটু আকাশ দেখার সময়ও পায়না। আমার একটা ছোটবোন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তাকে এখনই সৃজনশীল লেখার অনুশীলন করানো হয়। সে চার ঘন্টা হোমওয়ার্ক করে। তার মাঝেমাঝে খেলতে ইচ্ছা করে। আমার মা থাকে দু’গালে চড় বসিয়ে পড়তে বসান। আরে জিপিএ ৫ না পেলে কি সমাজে মুখ দেখানো যাবে নাকি! মাত্র ৬ বছর বয়সী আমার বোনটা মাঝেমাঝে বলে, ভাইয়া আমার মাথাব্যথা করে। এসির নিচে বসে দাঁত কেলিয়ে ১০ টা সৃজনশীল নিয়ে ভাবতে থাকা সরকারী আমলারা এই বাচ্চার মাথাব্যথার মর্ম কি বুঝবেন!
ওহ বলতে মনে নেই এরপর থেকে দশটা সৃজনশীল লিখতে হবে। এই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমার কিছু চাওয়ার নেই। মাদ্রাসায় পড়ুয়া হিসেবে বড় স্কুল-কলেজ থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া দেশের শিক্ষা আমাকে কিইবা দেবে! তবে আমরা না চাইতেও অনেক কিছু পাই। রাত জেগে হাজার স্বপ্ন নিয়ে পড়াশোনা করে তনুরা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় গিয়ে ধর্ষিতা হয়ে পড়ে থাকে। খাবার না কিনে ছেলেকে পড়ার জন্য টাকা দেয়া সেই ভার্সিটি শিক্ষার্থী আত্মহত্যার আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, ‘তোমার মেরুদণ্ডহীন বিদ্বান সূর্যসন্তানেরা তোমার এত উন্নতি করছে সেখানে আমি তোমার কি উপকার করছি বল? তোমার টাকায় পড়ে, খেয়ে
তোমার সিস্টেমের বিরোধিতা করছি, তোমার সাথে বেইমানি করছি। দেখে নিও, আর করব না। সেদিন ভিসি স্যার এবং চেয়ারম্যান স্যারের কাছে মাফ চাইনি। আজ তোমার কাছে মাফ চাইছি।’
আমরা মোমের পুতুল। পুতুলকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই খেলানো হবে। এটাই স্বাভাবিক। এই পুতুলদের নাচানোর আবার একটা মন্ত্রণালয়ও আছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বাচ্চারা বাচুক-মরুক অথবা তাদের ভবিষ্যৎ গোল্লায় যাক। ওই মন্ত্রনালয়ের কর্মীরা নতুন নতুন খেলা নিয়ে আসেন। আর শিক্ষার্থী নামেত পুতুলদের দিয়ে সেই খেলা খেলান। চলতে থাকুক খেলা।