-এশনা বিনতে আলী
আমার আম্মু ছোটবেলা থেকেই আমার এবং আমার ভাইয়ের সৃজনশীলতার বিকাশের জন্য অনেক কিছু করেছেন। যেমন দুই ভাইবোনকে অবসর সময়ে গল্প লেখার খেলায় মাতিয়ে দিতেন, বাসার আশেপাশের বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে সে স্থান সম্পর্কে বলতে এবং লিখতে বলতেন বন্ধুদের কাছে।
সেই দিন গত হয়েছে। সবার মা তো আর আমাদের মায়ের মতো না। তাই বাচ্চাদের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করার দায়িত্ব স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী নিজ কাঁধে নিয়ে নিয়েছেন। প্রতিবছর নতুন নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করে করে পরীক্ষা করেন কীভাবে আমাদের মেধার বিকাশ হবে। মেধার বিকাশের জন্য পরীক্ষা পদ্ধতিতে সৃজনশীল প্রশ্ন ঢুকিয়ে দিলেন। সৃজনশীল প্রশ্ন কাকে বলে? জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতামূলক চারটা প্রশ্নের সমন্বয়ে ১০ নম্বর মানের একটা প্রশ্নকে সৃজনশীল প্রশ্ন বলে। এই প্রশ্নগুলো দেয়া হয়েছিলো আমরা যেন সৃজনশীল চিন্তাভাবনা করে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারি। কিন্তু ২ ঘন্টা ১০ মিনিট সময়ের মধ্যে এধরণের প্রশ্ন ৬ টা উত্তর করতে গেলে চিন্তাভাবনা তো দূরের কথা, মুখস্ত পড়াগুলো মনে করার পর্যন্ত সময় থাকে না। ৬০ নম্বর উত্তর করতে মুখ থেকে ফেনা বের হওয়ার উপক্রম হতো। সেখানে নতুন মাত্রা যোগ করতে সৃজনশীল প্রশ্নের সংখ্যা বাড়িয়ে ৭ টি করা হলো। আর বাকি ৩০ নম্বর উত্তর করতে হতো এমসিকিউ। সেটাও মেনে নিয়ে একটা বছর সেভাবেই পরীক্ষা দিলাম। তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর নতুন বোধোদয় হলো যে এম.সি কিউ আসলে আমাদের কোন কাজেই লাগে না। তাই ১০০ নম্বরই সৃজনশীল প্রশ্ন করে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন তারা। শিক্ষার্থীরা সেটাও মেনে নিবে এবং সেভাবেই পরীক্ষা দেবে।
শিক্ষাব্যবস্থায় কয়দিন পরপরই এমন উন্নতিকরণ দেখে মনে হচ্ছে ‘সৃজনশীল শিশু গড়ো’ প্রকল্পে নেমেছেন শিক্ষামন্ত্রী। দেশের সকল শিশুকে বাধ্যতামূলক সৃজনশীল মেধাসম্পন্ন বানাতে গিয়ে আসলে যে তাদের সাধারণ মেধাকেই নষ্ট করে ফেলছে তা যদি একটু খতিয়ে দেখার কেউ থাকতো…
৩ ঘন্টায় সবগুলো সৃজনশীল উত্তর করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। মূল বই না পড়ে এখান-সেখান থেকে সাজশন নিয়ে সৃজনশীল মুখস্ত করি। পরীক্ষার খাতায় সেগুলো উগড়ে দিই এবং পরীক্ষা শেষে সেগুলো আবার নিজ দায়িত্বে ভুলে যাই। এই যদি মেধার বিকাশ হয় তাহলে তো বলতে হয় দেশ খুব দ্রুতই এগুচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকেও গ্রাস করে নিয়েছে সৃজনশীল পদ্ধতির পড়াশোনা। সরকার কর্তৃক প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাঠ্য বিষয়গুলোর পাশাপাশি আরো একটি বিষয় রয়েছে যার নাম ‘পরিবেশ পরিচিত’ বা সমন্বিত সমাজ ও বিজ্ঞান। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বাচ্চারা মূলত বর্ণমালা শিখতে শিখতে দুটো বছর পার করে। তাদের আবার পরিবেশ পরিচিতি! প্রশ্নের ধরণ খুবই সোজা। ‘তোমার মা-বাবা তোমার জন্য কী কী করেন?’, ‘তুমি বাসায় কী কী খাবার খাও?’, ‘আমাদের চারপাশের পাঁচটি জড় বস্তুর নাম লিখ।’ এইসব প্রশ্নের উত্তরের নোট প্রদানের জন্য অভিভাবকরা শিক্ষকদের চাপ দিতে থাকে। এগুলো নাকি ক্লাসে পড়ালে নম্বর পাওয়া যায় না। বাহ! কী সুন্দর মেধার বিকাশ!
দুটো ঘটনা দিয়ে শেষ করা যাক।
১.
দ্বিতীয় শ্রেণির সমন্বিত সমাজ ও বিজ্ঞান বিষয়ের মৌখিক পরীক্ষার সময় প্রশ্ন করা হয়েছিলো, ‘তোমার মা-বাবা বাসায় কী কী কাজ করেন?’
একজন ছাত্র উত্তর দিয়েছিলো, “ঘর গোছান, আমাদের পড়াশোনা করান, মা রান্না করেন, বাবা বারান্দায় গাছ লাগান।” আর বাকিরা সবাই হা করে তাকিয়ে থেকেছিলো। পরীক্ষা দিয়ে বাসায় গিয়ে সবাই কান্নাকাটি করলো। অভিভাবকরা এসে শিক্ষককে দোষারোপ করতে লাগলো বইয়ের বাইরে থেকে নাকি প্রশ্ন এসেছে।
২.
ষষ্ঠ শ্রেণিতে দেখতাম সবাই রচনায় ১০ পায় আর আমি পাই ৬/৭। প্যারাগ্রাফে ৯ পায় আর আমি পাই ৫/৬। কিন্তু আমি তো খুব ভালো করে সাজিয়ে রচনা আর প্যারাগ্রাফ লিখতাম, আমার নম্বর এত কম আসে কেন! এই ভেবে একদিন ক্লাসের বেশি নম্বর পাওয়া একজন শিক্ষার্থীর খাতা দেখলাম। ‘My Family’ প্যারাগ্রাফ এ দেখলাম লিখেছে তার দাদা-দাদীও তার সাথে থাকে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার দাদা-দাদী তোমাদের সাথে থাকে আগে বলোনি তো!” সে বলল, “আরেহ না। দাদা-দাদীর কথা না লিখলে প্যারাগ্রাফ বড় হয় না। নম্বর বেশি পাওয়া যায় না।”
‘আমাদের গ্রাম’ রচনায় যখন দেখলাম সে তার গ্রামের পাশের বয়ে চলা নদীর বর্ণনা দিয়েছে তখন আর গ্রামের পাশে নদী আছে কি না জিজ্ঞেস করতে হলো না। বুঝে নিলাম সৃজনশীলতার মূল্য নেই, তবুও সবকিছু সৃজনশীল।
পরীক্ষা পদ্ধতিতে সৃজনশীল প্রশ্ন সংখ্যা ১০ টা করুক আর ১২ টা যারা সৃজনশীলতা চর্চা করার তারা এমনি করে, তাদের পরীক্ষার খাতায় ১০ টা সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সৃজনশীলতা প্রমাণ করতে হয় না।