মহিবুল ইসলাম বাঁধন ||
আট বছর আগে সৃজার বিয়ে হয় শহরের এক ধনী ব্যবসায়ী আকমল হোসেন এর সাথে। দুই বছর পর তাদের কোল জুড়ে ফুটফুটে এক মেয়ে শিশু আসে । তাদের সাজানো সুখের সংসার দেখে বাইরে থেকে যে কেউ ঈর্ষা করবে।কিন্তু তবুও মানুষের চোখের আড়াল হলেই সৃজা সবসময় কী একটা ভাবতো। বিয়ের আট বছরের মাথায় এক সংবাদে তাদের স্বজনদের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। ব্রেইন ক্যান্সারে আক্রান্ত সৃজা।
নানা আলাপ-আলোচনার পর বেরিয়ে আসে আসল সত্য। বাইরে সৃজাকে খুব ভালোবাসলেও মেয়ে হওয়ার পর থেকেই তাকে নানাভাবে মানসিক নির্যাতন করতো আকমল। অতিরিক্ত চিন্তা আর চাপ সহ্য করতে না পেরে মাত্র বত্রিশ বছরের মাথায় না ফেরার দেশে চলে গেলেন সৃজা।
আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে সৃজার মতো অহরহ এরূপ ঘটনা ঘটেই চলেছে।আর এর মূল কারণ মানসিক চাপ।
নারী নির্যাতন বিষয়ক এক জরিপে দেখা গেছে, স্বামীর দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় ৬৫ শতাংশ নারী। আর মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় ৮২ শতাংশ নারী। এর মধ্যে বিবাহিত নারীরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়। তবে বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষাপটে মানসিক নির্যাতনকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব হয় না। যার কারণে সামাজিক এবং আইনিভাবে মানসিক বিষয়গুলোকে স্বামী স্ত্রীর নিজস্ব বিষয় বলে ধরে নিয়ে নিজেদের সমাধান করতে বলে।
কটুক্তি, টিটকারী, হেয় প্রতিপন্ন করা, খবরদারি মূলক আচরণ, ব্যক্তি স্বাধীনতা হস্তক্ষেপ, পৌরুষত্ব দেখাতে বিকৃত আচরণ, ঘরের বাইরে কাজ না করতে দিয়ে স্ত্রীকে অকর্মন্য প্রমাণ করা, সন্দেহপ্রবণতা ইত্যাদি বিষয় মানসিকভাবে নারীকে বিপর্যস্ত করে। পারিপার্শ্বিক কারনে নারী নিজের অবস্থান থেকে এ ধরনের মানসিক নির্যাতনকে সহ্য করে মানসিকভাবে নিজে সবল নয় বলে। তবে মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে আইনি প্রতিকার রয়েছে তা অনেকের কাছেই অজানা। পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইনে এ বিষয়ে মামলা করা গেলেও দেশে এ ধরনের মামলা করার হার মাত্র ৩ শতাংশ।
পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ এর ধারা ৩-এ মানসিক নির্যাতনের বিষয়টি আইন দ্বারা একটি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। যার মাধ্যমে স্পষ্টভাবে মানসিক নির্যাতন পারিবারিক সহিংসতার সংজ্ঞায় পড়ে এবং দেশের আইন অনুযায়ী এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ধারাতে বলা হয়েছে – ‘পারিবারিক সহিংসতা বলতে পারিবারিক সম্পর্ক আছে এমন কোনো ব্যক্তি দ্বারা পরিবারের অপর কোনো নারী বা শিশু সদস্যের উপর শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতিকে বুঝাবে।’
পরিবারেও নারীরা নির্যাতনের শিকার হয় প্রতিনিয়ত। পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় অগ্রসর নারীদের দমিয়ে রাখার প্রবণতার কারণে ঘরে ঘরে নারীদের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে এর মাধ্যমে। তাই এ বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
নারীদের প্রতি মানসিক নির্যাতন প্রতিরোধ করতে হলে সবার আগে সমাজ ও পরিবারের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। একজন স্বামীকে তার স্ত্রীর প্রতি মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে হবে। দাম্পত্য জীবনে নিজেদের বুঝাপড়ার ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। অধিকার বা কর্তৃত্ববোধের অহমিকা পারিবারিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দুজনের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা থেকে সন্তানের সুষ্ঠু জীবন পাওয়া সম্ভব এ কথাটা বুঝতে হবে। পরিবারের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রকে মানসিক নির্যাতন প্রতিরোধ বিষয়ে আরো বেশি সচেতনতা মূলক প্রচারণা চালাতে হবে। এছাড়া নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করতে আইন ব্যবস্থায় আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমার , আপনার, সকলের নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে কাজ করতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও অপরাধীর সুষ্ঠু বিচার করা সম্ভব হলেই নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করা সম্ভব।