জুবায়ের ইবনে কামাল
আপনি কি দেবী সিনেমা নিয়ে আমার মতই কনফিউজড ছিলেন? এটা আদৌ উপন্যাসের মত হবে তো! কিংবা সিনেমাটা দেখে ঠকবো না তো! এরকম প্রশ্ন কি আমার মত আপনার মনেও দোলা দিচ্ছিলো?
তবে চলুন আলাপসালাপ করি খোলামনে। দেবী উপন্যাস লেখা হয়েছে বেশ সময় আগে। সেসময়কার মত ছবি বানালে হলফ করে বলতে পারি আপনি সিনেমা হলে ঘুমিয়েই যেতেন। বর্তমান বাস্তবতাই আপনার চোখকে শান্তি দেয়। সুতরাং সিনেমাটা বানাতে হবে এমন ভাবে যেটা হবে ২০১৮ সালে। কিন্তু প্রেক্ষাপট থাকবে গল্পে উল্লেখিত আসল সময়ে। ব্যাপারটা কিন্তু খুব চ্যালেঞ্জিং! আর এটাতেই ছবির এক্সপেকটেশন বাড়িয়ে দিয়েছে।
গল্প যেহেতু সবারই জানা তাই স্পয়লার দিতে সমস্যা নেই। কিন্তু এখানেও একটা সমস্যা আছে। আপনি ঠান্ডা মাথায় ভাবুন, যখন আপনি একটা সিনেমা দেখা শেষ করেন তখন প্রথম কি নিয়ে চিন্তা করেন? আমার তো মনে হয় বেশীরভাগ দর্শকই আমার মত আগে কাহিনী নিয়ে চিন্তা করেন। কেউ সিনেমা হলে চঞ্চল চৌধুরীর ডায়ালগ দেখতে যায়না। যায় সিনেমার কাহিনী দেখতে। কাহিনীটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য তাই দর্শকের কাছে প্রাধান্য। আর সেখানে যদি কাহিনীটা সবাই হুবুহু আগে থেকেই জানে তবে সিনেমা বানানোটা কেমন চ্যালেঞ্জিং হবে? ভাবা যায়!
দেবীর মুল চরিত্র রানু নামের এক অস্বাভাবিক মেয়েকে নিয়ে। যিনি কিনা সময়ে অসময়ে ঘরের মধ্যে কারো নুপুরের আওয়াজ পান। কারো ডাক শুনেন। এটা খুব অস্বাভাবিক কোন বিষয় না বাস্তবে। তবে গল্পের নিখুঁত বাঁক এটিকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গেছে।
রানুর চরিত্রে অভিনয় করেছে জয়া আহসান। ছবিটির প্রোডিউসারও তিনি। তাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশী আলোচনা। সবচেয়ে বেশী সমালোচনা ছিলো রানু চরিত্রে জয়া কতটুকু গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে। উপন্যাসে বলা হয়েছে রানুর বয়স ১৭-১৮। জয়ার বয়স কি সেরকম?
তবে এখানেও একটা মজার ভুল করেছেন লেখক নিজেই। গল্পে রানুর বর্তমান সময় থেকে ১০ বছর আগের একটি বিশেষ কাহিনী জানার জন্য মিসির আলী যান মধুপুর। তখন রানুর বয়স দশ কিংবা বারো। তাহলে ১০ বছর আগের দশ-বারো বছরের একটি মেয়ের বয়স তো আর ১৬-১৭ না; বরং ২০-২২ হবে বটে। জয়া কে কিন্তু প্রায় সেরকমই লেগেছে। বিশেষ মুহুর্তে জয়ার অঙ্গভঙ্গি এমনকি তাকানোটাও ছিলো অন্যরকম। সুতরাং যারা রানুর চরিত্রে জয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তারা দয়া করে ছবিটা দেখে আমায় বলবেন তাকে ছাড়া অন্য কাকেই বা এই চরিত্রে নেয়া যেত।
আরে সিনেমার শুরুটাই তো বলা হয়নি। ১৭৫৭ সালের একটি কুমারী বিসর্জনের দৃশ্য দিয়ে সিনেমার শুরু। যেখানে একটি বালিকার শিরচ্ছেদ করতে গিয়ে নিজেই নিজের মাথা কেটে ফেলে একজন। সাদা-কালো ফ্রেমের সেই রক্তহিম করা দৃশ্য আপনাকে পুরো সিনেমা দেখতে বাধ্য করবে।
প্রথমেই বলেছি গল্পের প্রেক্ষাপট ঠিক রেখে ২০১৮ সালের প্লটে গল্প বলাটা বেশ কঠিন। কিন্তু দেবী সিনেমায় তা করা হয়েছে। এই সময়ের বাড়ি, রাস্তা কিংবা বাজার কোনটাকেই বেখাপ্পা লাগেনি। বরং ভালো লেগেছে সেসময়কার উড়ো চিঠিতে নীলুফার মধ্যে বেড়ে ওঠা প্রেম ২০১৮ সালে হয়ে উঠেছে মেসেঞ্জার চ্যাটে।
তবে বেখাপ্পা ব্যাপার একটা আছে। মুল গল্পে নীলু ছিলো একদম ঘরকুনো আর অসুন্দর। ছোটবোনের এত্ত এত্ত বন্ধু-বান্ধবের মাঝে জীবনের তুলনায় তার জগত ছিলো একা ও সাদামাটা। দেখতেও সে তেমন সুন্দর না। যেখানে কিনা নি:সঙ্গ নীলুর মত অসুন্দরকে দেখানো হয়েছে শবনম ফারিয়াকে। সে কি আসলেই নীলুর মত বাজে দেখতে?
আসল ব্যাপারটা অন্য জায়গায়। ছোটবোনের রঙ্গিন জগত দেখে নীলু নিজেই নিজেকে অসুন্দর মনে করতো। আর এজন্যই কিনা একদম অচেনা একজনের সাথে প্রেমের স্বপ্ন দেখে। আর ছবিতেও শবনম ফারিয়া কিন্তু সেরকমই অভিনয়টা করেছে।
শবনম ফারিয়ার নাম যেহেতু এসেই পড়লো খোলামনে কিছু বলতে কোন দোষ নেই। শবনম ফারিয়ার মত যারা নিয়মিত নাটক করে বেশির ভাগ দর্শকের কাছেই তাদের নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কারো কারো কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক কম। শবনম ফারিয়াকে স্ক্রিনে দেখানোর সাথে সাথেই আমার সামনের সারিতে থাকা একজন লোক বলে উঠলো,
‘আসছে ফারিয়া। এখন ন্যাকামি শুরু হইবো!’
কিন্তু আমার মনে হয় ফারিয়া এই চরিত্রে তার আগের সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। সুন্দর হয়েও নিজেকে অসুন্দর ভাবা, অগাছোলা ভাবে কথাবার্তা, চিন্তায় স্বচ্ছতা সহ একদম পারফেক্ট এক রোল প্লে করেছে সে। আমি অন্তত নিলুর চরিত্রে ফারিয়া আপুকে ছাড়া কাউকে চিন্তা করতে পারছিনা।
এবার আসি স্বয়ং মিসির আলী সাহেবের কাছে। উপন্যাসের মিসির আলী চরিত্র প্রায় কেউই ঠিকভাবে করতে পারবেনা। উপন্যাসের মিসির আলী সিনেমায় হয়না। এখন কথা হলো এখানে যিনি থাকবেন তিনি কতটুকু পোষাতে পারবেন। চঞ্চল চৌধুরী। পাকা গোছা চুলের মাঝে ঝুলে পড়া গাল ও কথায় গাম্ভীর্যতা মিসির আলীকে স্মরন করিয়েছে।
একটা বিষয় না বললে নয়। মিসির আলী খুবই গম্ভীর ও ভারি একজন মানুষের চরিত্র। সেক্ষেত্রে এই চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরীকে আক্ষরিক অর্থেই কিছুটা চঞ্চল মনে হয়েছে। কিছু ডায়ালগ যেন তাড়াহুড়া করে বলে ফেলতে দেখা গেছে। আমরা চেয়েছিলাম আরো শান্ত শিষ্ট মিসির আলী।
এখানেও একটা যুক্তি আছে বটে! দেবী মিসির আলীর প্রথম উপন্যাস। সেখানে মিসির আলীর বয়সের কোন প্রকার উল্লেখ নেই। যদিও ঠিক তার পরের বইতেই মিসির আলীর বয়স চল্লিশের বেশী বলা হয়েছিলো। সে হিসেবে আমরা আগের বইতে একটু তরুন ও আপেক্ষিক চটপটে মিসির আলীকে দেখতেই পারি। এতে দোষ তো নেই। আর যদিও মেনে নেই মিসির আলী বুড়োই। তবে এই ছোট্ট বিষয়টাকে আপনি কখনোই সিনেমার অসঙ্গতি বলতে পারেন না।
সত্যি বলতে একটা নিখাঁদ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার সিনেমা বাংলা ভাষায় দেখার সৌভাগ্য হলো বলে আমার মনে হয়েছে। পুরো সিনেমায় ছিলো অনেকগুলো ভয়ংকর দৃশ্য। বিশেষ করে ছোট্ট জিতু মিয়া যখন প্রস্রাব করে ফিরে তাকায় তখনকার দৃশ্য পুরো সিনেমা হলের কলজে কাঁপিয়ে দিয়েছে।
এছাড়াও জয়াকে বা রানুকে ছাঁদের রেলিং এর উপর বসে থাকা, ভিষণ যুক্তিবাদী মানুষও যখন যুক্তিহীনতার দ্বন্দে ভোগেন তখনকার অবস্থা দর্শকদের নাড়িয়ে দিয়েছে।
এডিটিং বা দৃশ্যগ্রহণও আমার কাছে বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ মনে হয়েছে। একটা দৃশ্যে দেখা যায়, যখন নীলুকে একটি ছেলে (ইরেশ জাকের) ধরে নিয়ে যায় তখন বাসায় নীলুর ছোটবোনের সাথে রানুর দেখা হয়। ফ্রেমে দেখা যাচ্ছে রানু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি ডাকছে তাকে নিচে আসবার জন্য। কিন্তু ফ্রেমে তাকে দেখা যাচ্ছেনা। ক্যামেরা স্থির রাখা হয়েছে রানুর উপর। সে তার কথা শুনে আস্তে আস্তে নামছে এদিকে ক্যামেরাও প্যান ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে তার সাথে এগুচ্ছে। যেন ডাক দেয়া মেয়েটির চোখ অনুসরণ করছে সিনেমার ক্যামেরা।
তাছাড়া এডিটিং এ নেই বাড়াবাড়ি বরং রয়েছে বৈচিত্র্যতা। ফ্ল্যাশব্যাক মানেই যেই সাদা-কালো ফ্রেমে পুরো কাহিনী দেখিয়ে ফেলা অথবা ভাইব্রেশনের স্পিডের মত ‘এই দৃশ্য-সেই দৃশ্য’ নয় তা এখানে বোঝা গেছে। রানুর অশুভ কিছু উপলব্ধি, পেছনের অন্ধকার কোন কাহিনী, অলৌকিকতার টুকরো টুকরো ছাপ ধীরে ধীরে দর্শকদের চোখে ছায়া ফেলা হয়েছে। অথবা নীলুর উপর ভর করা অলৌকিকতার আলোক সমানুতার ওঠা-নামা, পেরেক গুলো উঠে শরীরে বিধেঁ যাওয়া সবগুলোই ছিলো এক কথায় অসাধারণ। তাই এডিটিং আর সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে কোন কথা হবেনা!
খোলামেলা কথা বলেই এত কিছু বলে ফেললাম। মুলত সিনেমায় দেখানো আলাদা আলাদা প্রত্যেকটা চরিত্র নিয়েই বিস্তর আলোচনা করা যায়। রানুর স্বামী আনিসের মত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র কিংবা মিসির আলীর বাসার বাথরুমে কাজ করতে আসা মিস্ত্রি সকলের চরিত্রই ছিলো বেশ উল্লেখযোগ্য ও চোখে পড়ার মত। আরেকটা ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ছবি হলেও বেশ অনেকগুলো ডায়ালগ ছিলো পুরোই ফানি টাইপ! এতে ছবিকে আরো প্রাণবন্ত করেছে। তবে অসঙ্গতি যে একদমই ছিলোনা তা বলা ভুল হবে। আমার কাছে রানু-আনিসের পার্কে ঘুরে বেড়ানোর সময় বাজানো অনুপম রায়ের ‘দু মুঠো বিকেল’ গানটার কাহিনীর সাথে একদমই অসামঞ্জস্য লেগেছে।
যদিও ভালো বিষয় হলো মুল সিনেমায় তা খুব কম সময় দেখানো হয়েছে। এছাড়াও মিসির আলীর মধুপুর ভ্রমনটা আরেকটু বড় করে দেখানো যেত। নীলুর ছোটবোনের জগত একদম দেখানো হয়নি বললেই চলে। সেটা কিছুটা থাকলে মন্দ হতোনা। এছাড়াও অনিমেষ আইচের ডায়ালগে জড়তা রয়েছে। কিংবা সাউন্ডের সমস্যাও হতে পারে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকগুলো খুবই ভালো ছিলো। তবে কেমন যেন সব এক রকম টাইপ লেগেছে।
জাজ মাল্টিমিডিয়ার সিনেমা মানেই নড়েচড়ে বসা। এবারও তার ব্যাত্যয় ঘটেনি। অনম বিশ্বাস সম্ভবত কথা রেখেছেন। কথা রেখেছেন পুরো দেবী টিম। ভালো সিনেমা দেখতে যে কোন সময় দর্শকরা ছুটে আসেন তার প্রমান দেবী মুক্তির প্রথম দিনেই পাওয়া গেছে।
সবশেষে খোলামনে একটাই কথা। তাড়াতাড়ি সিনেমা হলে গিয়ে বসে পড়ুন। ঠকবেন তো না বটেই; বরং স্বাদ পাবেন এমন নতুন এক থ্রিলের যা দেখলে বাংলা সিনেমার গতানুগতিক ধারার উপর আপনার ধারণাটাই পালটে যাবে।