তাহমিদ শাহরিয়ার অনিম
আগামী বিনোদন ডেস্ক
অবিভক্ত বাংলায় ১৯০০-এর দশকে নির্বাক এবং পূর্ব বাংলায় ১৯৫০-এর দশকে সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শন শুরু হয়। এই অঞ্চলে চলচ্চিত্রের উৎপত্তি ১৯১০-এর দশকে হলেও এখানে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নিয়ে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে ১৯৫০-এর দশকেই। এখানকার সাংস্কৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতেই চলচ্চিত্রের প্রায় ৫০ বছরের মত সময় লেগেছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বাংলাদেশে অর্থাৎ তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানে তেমন কোনো শিল্পী ছিলেন না। একরকম স্থবিরতা চলে আসে এদেশের সাংস্কৃতিক জগতে। বেশির ভাগ শিল্পীই চলে যান ওপার বাংলায়। পশ্চিম পাকিস্তানে চলচ্চিত্র তৈরি হলেও বাঙালিরা পিছিয়েই থাকে। কিন্তু বাঙালির সংস্কৃতির প্রতি প্রেম দাবিয়ে রাখা সম্ভব হয় নি। আর এখানেই গড়ে উঠে বাঙালির উৎকর্ষ সাধনের উজ্জ্বল নমুনা প্রথম ঢাকাই বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’
বাংলাদেশের তথা তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম নির্মিত সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ। ১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসের ৩ তারিখ মুক্তি পায় ছবিটি। ছবিটি পরিচালনা করেন আব্দুল জব্বার খান। ছবিটি অর্থায়নে সহায়তা করে ইকবাল ফিল্মস। প্রধান অভিনয় শিল্পী ছিলেন আব্দুল জব্বার খান, পূর্ণিমা সেন, নাজমা, জহরত আরা, রহিমা, ফায়জা প্রমুখ। মুখ ও মুখোশ ছবিটি ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে একযোগে মুক্তি পায়। প্রথম চলচ্চিত্র হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই দর্ষকদের ভিতর আগ্রহের কমতি ছিল না ছবিটিকে ঘিরে। যেখানে নির্মাণব্যয় খরচ হয়েছিল ৬৪,০০০ রুপি সেখানে মুক্তির পর প্রথম দফায় ছবিটি ৪৮০০০ রুপি আয় করে।

সকল চলচ্চিত্র এবং এর কাহিনীর পিছনে থাকে কোনো উদ্দেশ্য, ভালবাসা কিংবা ঘাত-প্রতিঘাত। পূর্ব পাকিস্তানে নিজস্ব কোনো চলচ্চিত্র শিল্প ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের চলচ্চিত্র প্রযোজক এফ. দোসনির পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র প্রযোজনার ব্যাপারে নেতিবাচক মন্তব্যের প্রতিবাদ হিসেবে আবদুল জব্বার অনেকটা জেদের বসেই বলে ফেলেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন তিনি। পথচলা শুরু সেখান থেকেই।
১৯৫৩ সালে তিনি চলচ্চিত্রটির কাজ শুরু করেন। তিনি তার ডাকাত নাটক থেকে এই ছবির কাহিনী নেন। এছাড়া তিনি জসিমউদদীন এবং কাজী নজরুল ইসলামের কিছু বইকে বেছে নেন।কলকাতার চিত্রনাট্যকার মণি বোসের সাথে দেখা করে আব্দুল জব্বার তাকে চিত্রনাট্য লিখে দেয়ার অনুরোধ করলে মণি বোস সব বিবেচনা করে ডাকাত নাটকের পাণ্ডুলিপি চিত্রনাট্য হিসেবে প্রস্তুত করার পরামর্শ দেন।

সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয় ছবিটি। মুখ ও মুখোশ চলচ্চিত্রে এমন এক সময়ের গল্প বলা হয়েছে যখন সারা দেশ শমসের ডাকাতের লুটপাট, খুন, অত্যাচার-নির্যাতনে বিপর্যস্ত। শমশের ডাকাত তার দলবল নিয়ে একজন যাত্রীকে আক্রমন করে তার সবকিছু নিয়ে পালিয়ে যায়। ডেরায় যাওয়ার পথে তারা জঙ্গলের মধ্যে থেকে একটি বাচ্চা ছেলেকে উদ্ধার করে, যাকে তার বাবা মরে গেছে ভেবে চাকর দিয়ে কবর দিতে পাঠায়। বেশ কয়েক বছর পর পাকিস্তান সরকার শমশের ডাকাতকে ধরার জন্য পুরষ্কার ঘোষণা করে। কিন্তু ছদ্মবেশে থেকে ও থানার দারোগা জালালকে ঘুষ দিয়ে সে পালিয়ে থাকতে সমর্থ হয়। তার দলের আফজাল আর কুলসুম একে অপরকে পছন্দ করে এবং সুযোগ বুঝে পালানোর চিন্তা করতে থাকে। ইতিমধ্যে, শমশের জালালের বোন রাশিদাকে তার বাবার সাথে গ্রামে যাওয়ার পথে অপহরন করে তার ডেরায় এনে তুলে। শমশেরের মৃত্যু এবং দারোগা জালালের শাস্তির মাধ্যমে শেষ হয় ছবির গল্প।

আফজাল চরিত্রে কলিম শরাফী-কে অভিনয়ের প্রস্তাব নিয়ে চট্টগ্রামে যান আবদুল জব্বার খান ও তার দল। কিন্তু নায়ক চরিত্রের জন্য পারিশ্রমিক দেয়ার প্রস্তাব করে শরাফীর বন্ধুরা। অগত্যা, কলিম শরাফীকে কাস্ট করার চিন্তা বাদ দিতে হয়। কিন্তু চট্টগ্রামেই পাথরঘাটাস্থ মঞ্চঅভিনেত্রী পুর্ণিমা সেন গুপ্তার খবর পান জব্বার খান। পুর্ণিমার বাড়িতে গিয়ে ছবির নায়িকা চরিত্রের জন্য নির্বাচিত করেন পূর্ণিমাকে। ঢাকায় ফেরার পর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয় অন্যান্য চরিত্রের জন্য অভিনেতা বাছাইয়ের জন্য। বিজ্ঞাপন দেখে গোপনে যোগাযোগ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক অধ্যয়নরত ছাত্রী জহরত আরা এবং ইডেন কলেজের আই.এ-র ছাত্রী পিয়ারী বেগম। ক্যামেরাম্যান মুরারী মোহন ঘোষ পিয়ারী বেগমকে দুজন প্রধান নায়িকার একজন হিসেবে নির্বাচন করেন। শমসের ডাকাত চরিত্রে নেয়া হয় ইনাম আহমদকে, আফজাল চরিত্রে আবদুল জব্বার খান নিজেই অভিনয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আরও অনেক চরিত্রের মধ্যে নূরুল আনাম খাঁ, গওহর জামিল, ভবেশ মুখার্জী, বিনয় বিশ্বাস, আউয়াল খান প্রমুখ নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসের মধ্যে মুখ ও মুখোশের জন্য অভিনেতা অভিনেত্রী নির্বাচনের কাজ শেষ হয়।

ছবির নেগেটিভ ডেভেলপের জন্য লাহোরে পাঠানো হয়। এর আগে ১৯৫৪ সালের ৬ই আগস্ট আব্দুল জব্বার খান মুখ ও মুখোশের মহরত করেন হোটেল শাহবাগে। তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ইস্কান্দার মির্জা ছবির মহরতের উদ্বোধন করেন। দুইবছর কাজের পরে নির্মিত হয় বাংলা ভাষায় বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র। লাহোরে ১৯৫৬ সালে ছবির কাজ শেষ হলে ঢাকায় ফিরে আসার আগে এই ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয় লাহোরে। এরপর বাংলাদেশের নানা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ছবিটি। শুরু হয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের পথচলা।