তানযীল রশীদ
রৌদ্রজ্জ্বল এক ক্লান্ত দুপুর। হালকা মৃদু হাওয়া বইছে। শিল্পকলার প্রিয় টং এর মামা ঝাঁপি ফেলে তন্দ্রায় মগ্ন। মাঝে মাঝে এক – দুটো পাখি ডেকে উঠে শিল্পকলার ভেতরের নীরবতা ভাঙছে। সেদিন তোমার সাথে প্রথম দেখার দিনক্ষণ ঠিক হয়েছিলো। আর্ট গ্যালারীর নিচে ক্ষাণিক্ষণ বসে উঠে পড়লাম। ও ঠিক ১ টা ২৩ এ আসতে বলে বলেছিলে ঠিন যেন সময় মতন পৌঁছায়। অপেক্ষা করতে নীলাঞ্জনার বেজায় বিরক্ত লাগতো আর রেগেও যেতো ভীষণ। রাগলে অবশ্য ওকে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। আমি ৫ মিনিট ২৩ সেকেন্ড আগেই এসে তাই উপস্থিত। মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম ১ টা বেজে ২৩ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড হয়ে গিয়েছে। ভাবলাম মেয়ে মানুষ। হয়তো একটু সাজুগুজু করছে। হিজাব এদিকওদিক ঠিক করে হয়তো দেখছে আয়নায়। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। ভাবলাম নীলাঞ্জনা। মোবাইল হাতে নিয়ে পরক্ষণেই দেখি তৌকি। তৌকিকে ফোন করে আসতে বলেছিলাম, কারণ বেশ ক’দিন হলো শিল্পকলায় চা খাওয়া আর আড্ডা দেওয়া হয় না। ফোন অবশ্য অয়ন, সাইফ আর অন্তুকেও করেছিলাম। সাইফ আর অন্তুকে পাওয়া যাই নি, অয়ন তখন সেন্ট্রাল প্লাজা। তৌকি এরও আসতে দেরী হবে।ওরা অবশ্য নীলাঞ্জনার কথা জানে না। নীলাঞ্জনার কথা জানে সুমু আর সাফু। এই দুইটা মেয়েই ইদানিং আমার কাছ থেকে ভীষণরকম প্যারা খাচ্ছে। সুমু বোর্ডে টপ করা স্টুডেন্ট। বোর্ডে টপ করা স্টুডেন্ট কেন আমার মতো নিন্ম লেভেলের গাধামার্কা স্টুডেন্ট এর সাথে বন্ধুত্ব রাখে সেই সমীকরণ আমি অনেকদিন মিলাতে চেয়েও পারি নি। সাফু ভেতরের কষ্ট প্রকাশ করে অমায়িক হাসিতে। সাফুই অবশ্য বুঝিয়ে সুজিয়ে আমাকে শিল্পকলায় এনেছে।
আমি অস্থির প্রকৃতির মানুষ। এক জায়গায় স্থির থাকতে কষ্ট হয় ভীষণ। ভাবলাম যাই আরপেজিও পর্যন্ত হেঁটে আসি। জাহেদ ভাই নিশ্চয়ই এখন অফিসের লাঞ্চ ব্রেকে, তা না হলে মানুষটার সাথে দেখা করে আসা যেতো। বলাই হয় নি, আরপেজিও জাহেদ ভাইয়ের মিউজিক স্কুল। জায়গাটার প্রতি আমার ভীষণ আকর্ষণ। আমার খুব ইচ্ছে নীলাঞ্জনাকে নিয়ে আরপেজিও এর স্টুডেন্টস লাইভ পারফর্মিং সেশনে পারফর্ম করার। আমি অবশ্য গান করতেই পারি নাহ। আমি গান করলে ৩ মিনিটের গান ১ মিনিট ১৫ সেকেন্ড এর স্পিচ হয়ে যাই। নীলাঞ্জনা অবশ্য অসাধারণ গান করে। সে যাই হোক, হেঁটে আবারও শিল্পকলায় চলে আসলাম। শিল্পকলার বাইরে বেশ যান্ত্রিক শব্দ, ভেতরে অবশ্য সীমাহীন মাদকতা। টং দোকানী মামা তখনও ঘুমের দেশে। চা খেতে ইচ্ছে করছে খুব। ইদানিং চা পছন্দের তালিকার প্রায় শীর্ষে চলে এসেছে। নীলাঞ্জনা অবশ্য চা পছন্দ করে নাহ। লিপস্টিক এর সাথে অবশ্য ওর এই চা পছন্দ না করার সম্পর্ক থাকতে পারে। লিপস্টিক ওর বেশ পছন্দ। ভাবলাম অনেকদিন লেখালেখি হয় না। কিছু একটা লেখার অন্তত চেষ্টা করি।
নীলাঞ্জনা কবিতা ভালোবাসে খুব। আমি আবার কবিতা লিখতেই পারি নাহ। র্যাপ গানের লিরিক হলে সেটা ভেবে দেখা যেতো অবশ্য। অনিরুদ্ধ মুক্তমঞ্চের বাম পাশের সিঁড়িতে নোটপ্যাড আর কলম বের করে আঁকিবুঁকি করতে বসলাম। হঠাৎ দেখি শিল্পকলার গেইট খুলে নীলাঞ্জনা আসছে। পড়নে বাসন্তী রংয়ের শাঁড়ি আর খোঁপায় ফুল। ভুলোমনা মানুষ আমি, আজ কোন উৎসব কিনা তাই মনে করার চেষ্টা করলাম। নাহ, মনে পড়ছে না ঠিক। নীলাঞ্জনা যতই মুক্তমঞ্চের দিকে এগিয়ে আসছিলো মনে হচ্ছিলো বাতাসের গতি যেন বেড়ে যাচ্ছে, হার্টবিটও কেন জানি বেড়ে গিয়েছিলো। নোটপ্যাড আর কলম রেখে তখন আমি দাঁড়িয়ে। নীলাঞ্জনা মিষ্টি করে একটা হাসি দিলো। আমি মুচকি হেসে বসে নীলাঞ্জনার শাঁড়ির কুঁচি ঠিক করে দিতে লাগলাম। নীলাঞ্জনাও তখন মুচকি হাসছে। হাসলে ওর মুখে টোল পড়ে, ওর টোল পড়া হাসিটা আমাকে মাতাল করে সবসময়। কুঁচি ঠিক করে দিতে দিতে অবশ্য মাথায় এলো, আজ তো সত্যিই উৎসব। কাছে আসার উৎসব। ঘড়ির কাঁটায় তখন ২ টা বেজে ৪৩ মিনিট। শিল্পকলায় তখন এক মাতাল আবহ। টং এর মামা ঝাঁপি খুলে তখন চা বানাতে ব্যস্ত।
ছবিঃ নীলেশ রনি