ছোটগল্প: বাবা
পরীর দীঘির শ্যাওলা জমা শান বাঁধানো ঘাটে নিলু চুপচাপ বসে আছে। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ডুবিয়ে রেখেছে দীঘির শীতল জলে। কয়েকটা ছোট ছোট কুঁচো চিংড়ি নিলুর পায়ের কাছের স্বচ্ছ জলে বারবার ইতিউতি উঁকি দিচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকেই খপ করে পানিতে হাত ডুবিয়ে দেয় নিলু- ছোট্ট ছোট্ট হাতের মুঠোয় তুলে আনে কয়েকটা কুঁচো চিংড়ি। কিন্তু পরক্ষণেই আঙুলের ফাঁক গলে পগার পাড়! তারপর ডুব সাঁতারে কোথায় যে হারায়-কে জানে! আবার একটু পরই সব ভুলে ফিরে আসে!
বিকেলের ম্লান আলো অনেকক্ষণ আগেই নিস্তেজ হয়ে গেছে। থেমে গেছে পাখিদের কলকাকলিও। টুপ করে অন্ধকার নেমে পড়বে যেকোনো সময়ই। কুচকুচে কালো চাদরে ঢেকে ফেলবে পুরো রহমতপুর- শুরু হয়ে যাবে ঝি ঝি পোকার একটানা আর্তনাদ। নিলুর ছোট পিসি সেই কোন বিকেলেই নিলুকে বারদুয়েক ডেকে গেছে-কিন্তু নিতে পারেনি। অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বসে আছে-বাবা না আসলে যাবেই না সে। কিছুক্ষণ ঠোঁট চেপে কান্নাও করেছে নিলু। চোখের জলের সরু ধারাটা শুকিয়ে এখনো তার টোলপড়া গালে লেপ্টে আছে।
পূর্বদিকে দীঘির উপর হেলে পড়া হিজল গাছের বড় ডালটার ছায়ায় একজোড়া লালপদ্ম ফুটে আছে। নিলু উদাসী দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। একমনে বাবার কথাই ভাবছে। স্কুল ছুটির পর অয়নের বাবা যখন অয়নকে হাত ধরে বাসায় নিয়ে যায় তখন নিলুরও খুব ইচ্ছে করে-শক্ত করে বাবার হাত ধরে গল্প করতে করতে বাসায় ফিরবে। নিলু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে রেখেছে- রাস্তা পারাপারের সময় কখনোই অয়নের মতো দুষ্টুমি করবে না সে। স্কুলের সমস্ত গল্প জমিয়ে রাখে নিলু বাবাকে শোনানোর জন্য। খুব বলতে ইচ্ছে করে বাবাকে- ক্লাসের সবচেয়ে রাগী মিস আজ তার হোমওয়ার্কের খাতায় বড় বড় করে এক্সিলেন্ট লিখে দিয়েছে, হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার হেমা তাকে কনগ্রেচুলেট করেছে। প্রতিদিনই স্কুল ছুটির পর নিলু চাতক পাখির মতো গেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু বাবা তাকে কখনই নিতে আসে না। কখনোই না!
মায়ের ডাকে ধ্যান ভাঙে নিলুর। কিন্তু সাড়া দেয় না-চুপচাপ বসেই থাকে। নিলুর মা রাহেলা ছোট ছোট সিঁড়ি ভেঙে আস্তে আস্তে নিচে নামে। টলটলে পানিতে নিজেও পা ডুবিয়ে নিলুর পাশে ধপ করে বসে পড়ে। সাদা শাড়ী যে মুহূর্তেই শ্যাওলারাঙা হয়ে ওঠে সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপই নেই তার।
মাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে নিলু মুখ ফিরিয়ে অন্যপাশে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে রাহেলা আস্তে আস্তে বলা শুরু করে-
‘ভাষা-শহীদদের কথা জানো তুমি, নিলু?’
নিলু জানে সব, গতকাল বাংলার মিস- নুরুন্নাহার সুলতানা ক্লাসে তাদের সব বলেছেন। জানিয়েছেন- এগারো বছর আগে ৫২’সালে কিভাবে বাংলাকে বাঙালিদের মুখ থেকে কেড়ে নিতে চেয়েছিলো স্বৈরশাসকরা। কিন্তু নিলু মুখ খুলে না- কুলুপ এঁটেই বসে থাকে।
‘ভাষাশহীদদের স্মরণে মেডিকেল কলেজের সামনে শহীদ মিনার তৈরি করা হয়েছে। শুনছি কাল সকালে শহীদদের স্মরণে প্রভাতফেরীর আয়োজন করা হবে। নিলু, যাবে?’
নিলু কথা বলে না। চুপচাপ দীঘির ঘাট থেকে উঠে পড়ে। রাহেলার চোখ ভিজে ওঠে- সাথে সাথেই হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে জল মুছে ফেলে। তারপর নিলুর পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে। সারাটা পথ কেউ আর কোন কথা বলেনা।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,
আমি কি ভুলিতে পারি?’
মায়ের সাথে নিলুও গলা মেলাচ্ছে। আস্তে আস্তে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে শহীদ মিনারের মূল বেদীর দিকে। নিলু এক হাতে শক্ত করে মায়ের হাত ধরে রেখেছে, অন্য হাতে শিশির ভেজা তাজা কৃষ্ণচূড়া।
‘নিলু, ঐ দেখো তোমার বাবা।’ রাহেলার হাতের ইশারায় সামনে তাকায় নিলু। রাহেলা বলতে থাকে- ‘দেখো, তোমার বাবা বিশাল দু’হাতে ধরে রেখেছে টকটকে রাঙা ভোর। কত দায়িত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দৃঢ়, নিশ্চল, অবিচল। তোমাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে গেলে নতুন সূর্যটা কোথায় রেখে যাবে তোমার বাবা?’
নিলু মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার বাবার দিকে চেয়ে আছে। তাকিয়ে আছে বাবার হাতে ধরা লাল সূর্যের দিকে। সে দৃষ্টিতে অহংকার- বাংলা, তোমাকে পাওয়ার অহংকার!
লেখকঃ রাকিব হাসান
(বিজ্ঞান বিভাগ। ইন্টার প্রথম বর্ষ। শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ, ময়মনসিংহ।)