ইভান পাল
আজ গাইতে ইচ্ছে করছে“আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে,
কিংবা, ভূমি ব্যান্ডের ফাগুনের ও মোহনায়” গানটি।
আবার এও গাইতে ইচ্ছে করচ্ছে-
ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে।
কেন গাইছি এই গানগুলো। আমি জানি আপনাদের মনের রাজ্যে হাজারো প্রশ্ন উকিঁ ঝুকিঁ দিচ্ছে।
তবে আমার মন বলছে, আপনারাই শেষের গানটি দিয়ে কিছু একটা বুঝতে পেরেছেন। ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে।
হুম, ঠিক ধরেছেন। আজ পহেলা ফাল্গুন। ফাগুন ও বলা হয়ে থাকে।
আর আমরা জানি ফাগুন বা ফাল্গুন সে যাই ই হোক, যাই ই বলে থাকি না কেন এই আপামর বাঙ্গালি এই দু’টো শব্দ দিয়ে কিন্তু একটা ঋতুকেই বোঝে থাকে আর তা হল– “ বসন্ত”।।
ষড় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। প্রতি বছরই এই ছয়টি ঋতু হাজারো রকমের পসরা নিয়ে হাজির হয় রুপসী বাংলার এই প্রকৃতিতে।
আর এই প্রকৃতিকে সাজিয়ে তোলে নানা রঙ্গের রংধনু দিয়ে।
তো, এই রুপসী বাংলার প্রকৃতির ছয়টি ঋতুর মধ্যে একটি হল এই বসন্ত। আবার এও বলা যেতে পারে প্রকৃতির শেষ ঋতু হচ্ছে বসন্ত।
ফাল্গুন ও চৈত্র এ দুমাস বসন্তকাল। তার মানে, আজ থেকে শুরু করে আগামী দুমাস প্রকৃতির রাজ্যে বসন্ত তার মায়াবী জাদুকরী ছন্দে সক্কলকে মাতিয়ে রাখবে।
বসন্ত কে বলা হয় ঋতুরাজ। অর্থাৎ, ঋতুদের রাজা। কারণ, এই ঋতুতে বিভিন্ন রকমের ফুল ফুটে, গাছে নতুন পাতা গজায়, নতুন গাছের জন্ম হয়। এই সময় অনেক পশুপাখি মিলন ঘটায় এবং বাচ্চার জন্ম দেয়। এ একক অন্য রকম ব্যাপার। আবার পৃথিবীর অনেক জায়গায় এই সময় বৃষ্টিও হয়। এর ফলে গাছপালা বেড়ে উঠে, ফুল ও ফলের পরবর্তী বেড়ে ওঠায় গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে।
আর বাংলার প্রকৃতির জগতে বসন্ত নিয়ে সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, ফুল। শিমুল, কৃষ্ণচুড়া’র মিষ্টি গন্ধে পল্লী প্রকৃতির প্রতিটি স্থান ম ম করে। আবার পল্লী গায়ের ওই ফুলের বাগান গুলোতে খুদেদের চলে ফুল কুড়ানোর উৎসব। তবে এগুলোই শেষ নয় আরো আছে– অশোক , আকড়কাঁটা, হিমঝুরি, ইউক্যালিপটাস, রক্তকাঞ্চন, কুরচি, কুসুম, গাব, গামারী, গ্লিরিসিডিয়া, ঘোড়ানিম, জংলীবাদাম, জ্যাকারান্ডা, দেবদারু, নাগেশ্বর, পলকজুঁই, পাখিফুল, পালাম, বুদ্ধনারিকেল, মনিমালা, মহুয়া, মাদার, মুচকুন্দ, রুদ্রপলাশ, শাল , শিমূল, স্বর্ণশিমূল, ক্যামেলিয়া ইত্যাদি। মনে হয় প্রকৃতি তার সমস্ত সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়ে সামনে আসে। তাই তো একে ঋতুরাজ বলা হয়।
তবে কবি কিংবা সাহিত্যিকদের কাছে বসন্ত মানে হল প্রেমের ঋতু। আবার কেউ কেউ মনে করেন, বসন্তের সঙ্গে সম্পর্ক আছে কামের।
যাক, অতদূরে নাই বা গেলাম। তবে রবিঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, কবি নির্মুলেন্দু গুন সহ বাঙলা সাহিত্যের প্রায় প্রত্যেক সাহিত্যিক ই করে গেছেন বসন্ত বন্দনা। কেন করবে না বলুন, বসন্ত মানেই যে — প্রেম। ভালবাসা। সে প্রকৃতি প্রেমই হোক আর মানব প্রেম ই হোক। আর তার জন্যেই তো বহু ভিনদেশী এদেশে এসেছেন। প্রেমে পড়েছেন এদেশের ভুবনভোলানো প্রকৃতির রুপ দেখে। আর এসময় মানুষের মধ্যেও প্রকৃতির পরশে এক স্নিগ্ধতা’র আমেজ বিরাজ করে।
এসময় সবখানে ফুলের চাহিদা বেড়ে যায়। বিশেষ করে ব্যাপারটা বেশী দেখা যায়, তরুণ – তরুণীদের মধ্যে। ইচ্ছে বা কারণ একটাই– বসন্তের তাজা ফুল দিয়ে তার মনের মানুষটিকে শুভেচ্ছা জানানো। তাইতো বলছি, বসন্ত মানে ভালবাসা আর প্রেমের ঋতু।
তাই আজ মন খুলে গাইতে ইচ্ছে হচ্ছে — “আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে”।। হ্যা, চারদিকে আজ শুধু আনন্দ আর আনন্দ। আনন্দের জোয়ার বইছে উদ্ভিদকুল,প্রাণীকুল সবার মাঝে। বসন্ত এসেছে যে!
কে জানে, হয়তো প্রাণীকুলে এসেছে নতুন অতিথি। আর তাদের ঘরে ঘরে চলছে তাই নিয়ে উৎসব। আচ্ছা, আমরা তো এই পৃথিবীতে নতুন অতিথি এলে মিষ্টি বিতরণ করি। ওরা কি করে? কে জানে। থাক না যাই ওই পর্বে। তখন আবার তা রুপকথার গল্প হয়ে যাবে।
বসন্তে দূর গহীন বন থেকে কানে ভেসে আসে পাখির কলরব ধ্বনি। আর এ ঋতুর বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে — কোকিল। যখন গাছে গাছে নতুন পাতা উকিঁ দেয় তখন সেই কচি পাতার আড়াল থেকে গান ধরে গানের পাখি কোকিল। মনে হয় সে যেন তার, মিষ্টি কন্ঠের গান দিয়ে সব দু:খ কষ্টকে ভুলিয়ে ভালবাসতে শেখায়। সে যেন তার মিষ্টি কন্ঠের সুরেলা জাদুতে জাগিয়ে তোলে এই পল্লী প্রকৃতিতে।যেন সবকিছুতে প্রাণের সঞ্চার করেছে।

এছাড়াও বসন্তে ঘুঘু, শ্যামা আর আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েলের বিচরণ তো থাকেই।
আর ফাগুনের বাতাস সবকিছুকে জুড়িয়ে দেয়। এই বাতাসে যখন গাছ-গাছালিগুলো যখন নড়ে ওঠে তখন পাতার সব মর্মর ধ্বনি মন মাতিয়ে দেয়।
শীতকালে শীতের প্রকোপে মানুষের জীবনযাত্রা অনেকটা স্থবির থাকে। ঠান্ডায় সকলে উবু-থুবু হয়ে বসে থাকে। প্রকৃতি থেকে প্রাণচাঞ্চল্য অনেকটাই কমে যায়। কিন্তু বসন্ত এসে চাঙ্গা করে দেয় এই পুরো জগৎ কে।
এবার একটু বসন্ত উৎসবের কথায় বলি। আমি আগেই বলেছি, বসন্ত মানে হল আনন্দের ঋতু। আর তার জন্য উৎসব প্রিয় এই বাঙ্গালিদের কাছে বসন্ত মানে এক উৎসবের ঋতু। এই সময় গ্রামগুলোতে হাজারো রকম পসরা নিয়ে গ্রাম্য মেলার আসর বসে। নাগরদোলা, কিংবা যাত্রাপালা সবই থাকে এতে। আর পণ্যসম্ভার নিয়ে ছোট ছোট দোকানগুলো তো থাকেই। আবার কোথাও কোথাও বাউল গানের আসর বসে।

আর এসময়ে সবথেকে উল্লেখ্যযোগ্য ধর্মীয় উৎসব বাসন্তী পুজা। যা দুর্গাপুজার ই আরেকটি রুপ। হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ চন্ডীতে বলা হয়েছে, এ বাংলার ই এক রাজা যার নাম সুরথ। তিনি শত্রু পক্ষের আক্রমণে তারঁ নিজ রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে পথে পথে ঘুরছিলেন। তখন তিনি দেখা পেলেন সমাধি নামের এক বৈশ্যের। তাকেঁ ও তারঁ স্ত্রী, পুত্ররা ধনসম্পদের লোভে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তো, তারা দুজনে মেধসমুনির আশ্রমে যান। সেখানে মেধস মুনির উপদেশে তারা যেন সবরকম বিপদ,সমস্ত সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পারেন তার জন্য তারা দেবী দুর্গার আরাধনায় মগ্ন হলেন। আর তারপর রাজা সুরথ তারঁ হারানো রাজ্য ফিরে পেলেন। আর সমাধি বৈশ্য তত্ত্বজ্ঞান লাভ করলেন। বসন্তকালে এ পূজো হয় বলেই একে বলা হয় বাসন্তী পূজো। আর হিন্দুধর্ম মতে এটাই কিন্তু তাদের কালের পূজো।
যাক, বসন্তের উৎসব এখানেই শেষ নয়। আমি শুরুতে একটা পাহাড়িয়া গান ধরেছি—
“ফাগুনের মোহনায় মন মাতানো মহুয়ায়
রঙ্গীন এ বিহুর নেশা কোন আকাশে নিয়ে যায়”।

বসন্তে বিহু উৎসব অনুষ্টিত হয়। এটি মূলত: উপজাতিদের উৎসব। পশ্চিম্বঙ্গের(ভারত) আসামের উপজাতিদের বিখ্যাত উৎসব এই বিহু। বাংলাদেশেও এই উৎসব উদযাপিত হয়ে থাকে। বিহু কৃষিভিত্তিক একটি উৎসব। কৃষিব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে বিহু মূলত: তিনধরনের। আর এগুলি হল,, ব’হাগ বিহু বা রঙ্গালী বিহু, কাতি বিহু বা কঙ্গালী বিহু এবং মাঘ বিহু বা ভোগালী বিহু।আর বসন্তে উদযাপিত হয় ব’হাগ বিহু বা রঙ্গালি বিহু। আসামের মূল বিহু উৎসব বসন্তের শুরুতে উদযাপন করা হয়। রঙ্গালী বিহু যৌবনের উৎসব। এটি সাতদিন ধরে উদযাপন করা হয়। সাধারণত এ উৎসবে তারা বিভিন্ন পিঠাপুলি বানিয়ে নতুন কাপড় পরিধান করে। আর তারা তাদের আরাধ্য দেবতার নিকট তা নিবেদন করে। আর বিহু নৃত্য, বিহু সংগীতের মাধ্যমে মহাসমারোহে তারা এই উৎসব উদযাপন করে থাকে। (বিহু:উইকিপিডিয়া)
নাগরিক জীবন কিংবা আমাদের শহুরে জীবনে বসন্ত উৎসব বলতে, শুধু ঘুম দিয়ে কিংবা ব্যস্ততা দিয়ে দিন শুরু করা নয়।
বরং, গ্রাম ছাপিয়ে শহরেই আজকাল বসন্তের বিলাপ একটু বেশীই চোখে পড়ে। প্রতিবছর আমাদের বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বসন্ত উৎসব মহাসমারোহে উদযাপন করে থাকে। ভোর থেকে শুরু হয় গান, নাচ আবৃত্তি। এ যেন এক প্রাণের মেলা বসন্তের মেলা। ভালবাসার মেলা। জাতীয় বসন্ত উদযাপন পরিষদ প্রতি বছর এ উৎসব উদযাপন করে থাকে। এছাড়াও বসন্তকে ঘিরে ছায়ানট সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর আয়োজন থাকে চোখে পড়ার মতো। চলে রংতুলিতে বসন্তকে ফুটিয়ে তোলার কাজ, থাকে আদিবাসী নৃত্য। আর গান তো থাকেই। কারণ, গান ছাড়া যে বাঙ্গালির উৎসব হই ই না।
আর, চারুকলার কথা কিই বা বলব। উৎসব মানেই চারুকলা। সে যে উৎসব ইই হবে হোক না কেন। চারুকলায় শীত বিদায় আর বসন্ত বরণ কে ঘিরে চলে ছবি আকাঁ, প্রদর্শনী, গান, আড্ডাসহ বিশাল আয়োজন।

১লা ফাল্গুনে, বাংলাদেশের বেশীরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও চলে বসন্ত বরণ উৎসব।বিশেষত কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে।
আর যদি একটু আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, তাদের পশ্চিমবংগ, আসাম ত্রিপুরাতেও কিন্তু এই বসন্ত উৎসব ধুমধামের সাথে পালন করা হয়।
আর রবিঠাকুর এর স্মৃতিবিজড়িত স্থান শান্তিনিকেতন তো বসন্ত উৎসব মানেই একটা বিশাল ব্যাপার।তবে তা হয় ফাগুনের শেষদিকে। নাচ-গান, খোল, করতাল আর ঘনবাদ্য সাথে শোভাযাত্রায় মুখরিত হয় পুরো শান্তিনিকেতন যা বর্তমানে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত। আর বসন্ত যেহেতু রাঙ্গিয়ে দেওয়ার ঋতু তাই চলে রং এর খেলাও। ধূসর নয় বরং রংধনুর রঙ্গে রাঙ্গা হোক সকলের জীবন এটাই থাকে এই রং ব্যবহারের মাহাত্ম্য।
উল্লেখ্য, ১৯২৫ সালে শান্তিনিকেতনের আশ্রমে বসন্ত উৎসব শুরু হয়। তখন,২৫শে ফাল্গুন শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। আর সেই স্থানেই পদধূলি পড়েছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। বলা হয়ে থাকে, তিনি শেষবারের জন্য শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসবে এসেছিলেন ১৯৪০সালের ২৭শে মার্চ।
বাংলাদেশের যেসকল সরকারি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রতি বছরই তাদের বসন্ত বরণ নিয়ে তো বিশাল ব্যাপার থাকেই। আড্ডা, গল্প, গান, নাচ সব মিলে একাকার। আমি শুধুু ঢাকার কথা বলছি না, বাংলাদেশের সকল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কথাই বলছি। আসলে প্রকৃতিপ্রেমী বাঙালিদের স্বভাবটাই এমন। তারা প্রকৃতির প্রতিটি রুপকেই ভালবাসার চাঁদরে বরণ করে নেয়। আর বাঙ্গালির জীবনে তো গান, গল্প, আড্ডা তো থাকেই।
পরিশেষে, শিল্পী লগ্নঞ্জিতা চক্রবর্ত্তীর সুরে যদি সুর মিলিয়ে বলি“ বাতাসে বহিছে প্রেম –
নয়নে লাগিল নেশা।
কারা যে ডাকিছে পিছে,
বসন্ত এসে গেছে।”
বাতাসে প্রেমের গন্ধ আর চোখে যখন তারই নেশা আবার তখন এই প্রকৃতি ই যেন ডাক দিয়ে বলছে “বসন্ত” এসে গেছে। আর বসন্ত ই হল সেই মায়াবী জাদুকর যা আমাদের ভালবাসার মায়ায় ভাবিষ্ট করে রাখে। তাই “ফুল ফুটুক কিংবা নাই বা ফুটুক আজ ১লা ফাল্গুন, আজ বসন্ত”।