১. দরজা খুলে যে সুদর্শন যুবক ভেতরে ঢুকলো সে ডিউটিরত ডাক্তার। হাসিমুখে ভেতরে ঢুকলো। সাথে সাথে আমি মনের ভেতর এক নাটকীয় দৃশ্য কল্পনা করতে লাগলাম। আমার হাত ধরে পালস চেক করবে, কপালে হাত দিয়ে দেখবে জ্বর আছে কি না। এসব কল্পনায় বাধা পড়লো সুদর্শনের ধমক খেয়ে। “তুমি নাকি উল্টাপাল্টা জিনিস খেতে কান্নাকাটি করো?” এত ভারী কণ্ঠ শুনে ভয় পেলাম। কথাটা ধমক দিয়ে বলার মতো না তবুও তিনি কেন ধমকের সুরে বললেন! আজ আমি ফর্সারকম সুন্দরী না বলে!
২. আজ ডিউটিতে একজন মহিলা ডাক্তার। তিনিও আজ ধমকে কথা বলে গেলেন। তখন বুঝতে শুরু করলাম ডাক্তাররা সবসময় রোগীদের ধমকে কথা বলেন। তবে এই ডাক্তারটা খুবই অবাক হলেন, যখন দেখলেন হাসপাতাল থেকে পথ্য হিসেবে যেই অখাদ্য স্যুপটা দেওয়া হয় সেটা আমি ভীষণ আগ্রহ নিয়ে খাই। তাঁর চেহারা দেখে বুঝলাম তিনি আমাকে একটু আদর করতে চাইছেন কিন্তু ডাক্তারদের গুরুগম্ভীর থাকার ‘ট্রেন্ড’ অনুসরণ করা ছাড়া উপায় নেই।
৩. আজকের ডাক্তারটাও মহিলা। নাহ, মহিলা বললে ভুল হবে। ৩০ বছর বয়সী মেয়েরা অবশ্যই মহিলা হয়ে যায় না। সব মেয়ে ডাক্তারই কি ফর্সা হয়! আর অনেক সুন্দরী! তাঁর ক’দিন আগেই বিয়ে হয়েছে। হাতে মেহেদী, হালকা সাজ দেখেই বুঝতে পারলাম। ডাক্তারদের কখনো চুড়ি পরে আসতে দেখি না। তিনি একহাতে ঘড়ি আর আরেকহাত ভর্তি চুড়ি পরে আছেন। সাজসজ্জা বলতে কপালে টিপ, চুড়ি আর চোখে কাজল। ভাবছি, আমার বিয়ে হলে তো আমি হাসপাতালেই আসতাম না। বউ সেজে বাসায় বসে থাকতাম। আবার মনে হলো যে আমি তো ডাক্তার না, ডাক্তারদের মতো মানসিকতা হয়নি আমার। আমি যদি ডাক্তার হতাম তাহলে দেখা যেত আমিও ছুটে আসতাম হাসপাতালে।
৪. আজ আশা করছিলাম একজন ছেলে ডাক্তারকে। কিন্তু দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো মাথা থেকে পা অবধি কালো বোরকায় ঢাকা একজন মহিলা। এপ্রোন পরা না থাকলে আমি তো ভয়ই পেয়ে যেতাম। আমার সামনে দাঁড়িয়ে মুখের কাপড় সরালেন। আমি চমকে উঠলাম। আমি ভেবেছিলাম বয়স্ক মহিলা হবে। কিন্তু তিনি যুবতি। দুগাল জোড়া হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি একটু অপ্রস্তুত বোধ করলাম। কী করবো বুঝতে না পেরে নিজের বাম হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। তিনি খিলখিল করে হেসে বললেন, “আমি পালস চেক করতে আসিনি। তুমি নাকি এখানের সবচেয়ে কম বয়সী রোগী? তাই তোমাকে দেখতে এলাম।” আমি বললাম, “ও আচ্ছা।” তিনি আরো কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন।
সেদিন রাতেই ডান হাতের যে জায়গায় ক্যানোলা লাগানো সেখানটায় অনেক চুলকানি শুরু হলো। সারারাত ঘুমালাম না। ভোরের দিকে কষ্টে কেঁদে ফেললাম। ডাক্তারকে ডাকলাম। তিনি এসে একটা ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়ে গেলেন। ঘুম ভাঙলো বিকেলে। স্যালাইনের নলে নোট লাগানো ছিলো। ‘তুমি ঘুমাচ্ছিলে, বিদায় নিয়ে যাওয়া হলো না।’ হাসপাতালে থাকাকালীন ‘বিদায়’ শব্দটা খুব খারাপ লাগতো। যথেষ্ট অলক্ষুণে শব্দ ‘বিদায়’।
লেখা-এশনা বিনতে আলী