হাসান ইনাম
“ আজ এ-তথ্য সুবিদিত যে, ঔগ্রসৈন্যের সমবেত প্রাচ্য-গঙ্গারাষ্ট্রের সুবৃহৎ সৈন্য এবং তাহার প্রভূত ধনরত্ন পরিপূর্ন রাজকোষের সংবাদ আলেকজান্দারের শিবিরে পৌছিয়াছিল এবং তিনি যে বিপাশা পার হইয়া পূর্বদিকে আর অগ্রসর না হইয়া ব্যাবিলনে ফিরিয়া যাইবার সিদ্ধান্ত করিলেন, তাহার মূলে অন্যান্য কারণের সঙ্গে এই সংবাদগত কারণটিও অগ্রাহ্য করিবার মত নয়।” – ঐতিহাসিক ড. নীহাররঞ্জন রায়
ড. নীহাররঞ্জন রায় এর কথা এখানেই থাক। আমরা একটু অন্য দিক থেকে ঘুরে আসি চলুন। প্রাচীন ভারতের এই ম্যাপটির দিকে একটু চোখ রাখুন।

এটি হচ্ছে খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৫ম শতকের ম্যাপ। তৎকালীন মগধ রাজ্যের আনুমানিক প্রমাণ। এই রাজ্য বর্তমানের বিহারের পাটনা, গয়া আর বাংলার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিল।
এই মগধ রাজ্যকেই গ্রীক ঐতিহাসিকগ লিখেছেন গঙ্গারিডই (Gangaridi) অথবা গন্ডারিডাই (Giandaridi) নামে একটি জনপদ। মগধ রাজ্যকেই গঙ্গারিডই বলা হয় কীনা তা নিয়ে মতানৈক্য আছে। তবে প্লিনি (Pliny) বলেন,
গঙ্গা নদীর শেষ ভাগ এই রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তাই মনে করা হয় গঙ্গারিডাই যে রাজ্যই বলা হোক না কেন সে রাজ্যের অন্তর্গত ছিল বাংলাদেশ। সে কথা আমরা বলতেই পারি আর ইতিহাসও এই বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়।
এবার আমরা আসল আলোচনাতে ফিরে যাই।
মহান আলেকজান্ডারকে আমরা সবাই চিনি। এই মহান বিজেতাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছুই নেই। আলেকজান্ডার সুদূর গ্রিস থেকে একের পর এক রাজ্য জয় করে ইরান আফগানিস্তান হয়ে ভারতে পৌছে যায়। সিন্ধু নদ তখন ছিলো পারস্যের সীমানা। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ অব্দে তিনি পারস্য সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন।

খ্রিস্টপূর্ব ৩২৮ অব্দের মধ্যে সমগ্র পারস্য এবং আফগানিস্তান আলেকজান্ডারের দখলে আসে। আলেকজান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে ভারত অভিমুখে অগ্রসর হন এবং ৩২৬ অব্দে তিনি ভারত নাম ভূখণ্ডে পদার্পণ করেন। আলেকজান্ডার তৎকালীন পুষ্কলাবতীর রাজা অষ্টককে পরাজিত করেন, অশ্বক জাতিও তার নিকট পরাজিত হয়, তক্ষশীলার রাজা তার নিকট স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন, ঝিলাম রাজ পুরু সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে পরাজয় মানতে বাধ্য হন। অতঃপর আরেকজান্ডার রাভি নদীর উপকূলবর্তী রাজ্যসমূহ দখল করেন এবং বিপাশা নদী পর্যন্ত অগ্রসর হন।
তখন আলেকজান্ডারের সামনে মাত্র একটা বাধা, বিপাশা নদীর ওপারের গঙ্গারিডই রাজ্য। ভারতের মূল ভুখন্ড। এটুকু করতলগত হলেই সমগ্র ভারত তার দখল হয়ে যাবে। যে স্বপ্ন নিয়ে নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিলো গ্রিক রাষ্ট্র মেসিডোনিয়া থেকে সে স্বপ্ন পরিপূর্ণতা পাবে। যে গঙ্গারিডই রাজ্যের কথা আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি।
গঙ্গারিডইয়ের সমর শক্তি সম্পর্কে মেগাস্থিনিস লেখেন –
‘গঙ্গারিডাই রাজ্যের বিশাল হস্তী-বাহিনী ছিল। এই বাহিনীর জন্যই এ রাজ্য কখনই বিদেশি রাজ্যের কাছে পরাজিত হয় নাই। অন্য রাজ্যগুলি হস্তী-বাহিনীর সংখ্যা এবং শক্তি নিয়া আতংকগ্রস্ত থাকিত’
আলেকজান্ডারের সৈন্যরা বছরের পর বছর যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া যখন নদীর ওপাড়ের ভয়াবহ সেনাবাহিনীর কথা শুনলো তখন বিদ্রোহ করলো। তখন বিচক্ষণ সেনাপতি সৈন্যদের পক্ষ হয়ে জানালো সৈন্যরা কেউ বিপাশা পার হয়ে নিজের জীবন দিয়ে আসতে রাজী নয়, তারা পিতা-মাতা, স্ত্রী, সন্তান ও জন্মভুমিতে ফিরে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। এভাবে সৈন্যদের দাবীর ফলে পাঞ্জাবের বিপাশা নদীর অপর পাড়েই গ্রিক বাহিনীর বিজয় রথ থেমে গেলো। আলেকজান্ডার এরপর গ্রিক বাহিনীকে মেসিডোনিয়ার দিকে ফিরতি যাত্রার নির্দেশ দিলো।
ডিওডোরাস লেখেন –
‘ভারতের সমূদয় জাতির মধ্যে গঙ্গারিডাই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই গঙ্গারিডাই রাজার সুসজ্জিত ও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত চার হাজার হস্তী-বাহিনীর কথা জানিতে পারিয়া আলেকজান্ডার তাহার বিরূদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হইলেন না’।
সেই গঙ্গরিডইয়ের অংশ আজকের বাংলাদেশ। যারা চির অপরাজিত। কখনই মাথা নত করেনি।