Wednesday, April 30, 2025
23.1 C
Dhaka

গল্পঃ হারানো মায়ের স্মৃতি

সাইফুর রহমান দিদারঃ
কবুল বলো, কবুল! চুপ করে থেকো না। আমাদের আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে! পাজোড়া আর মানে না। সারাদিন শরীরের উপর অনেক ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে। এখন শরীর মেলে একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। তা ছাড়া ওদিকটাতে একটু কাজ আছে। দায়িত্বে নাম লেখানো সকলকে চোখে চোখে,বেশ খেয়াল করে রাখতে হচ্ছে। কোন সময় আবার কী করে বসে। উফ। দায়িত্বে সবার অবহেলা। একমনে কাজ করবে তা না। এতক্ষণ বিড়বিড় করে দাঁড়ি-কমাবিহীন কথা গুলো বলে যাচ্ছে-দিলরুবার মামা। আবারও ঝাঝালো কন্ঠে বলে উঠল-কবুল বলো না। আমরা তো তোমাকে আর অপাত্রের হাতে তুলে দিচ্ছি না। দেখে শুনেই, সব জানার পর বিয়ে দিচ্ছি। তা ছাড়া ছেলেটা অনেক ভালো। টাকাপয়সার ও কম নেই। তোমার এসব নিয়ে কষ্ট করতে হবে না। বসে বসে খেতে পারবে!

চুপ থাকা সম্মতির লক্ষণ! এটা জানার পরও মামা,দিলরুবার মুখ থেকে কবুল শুনতে দাঁড়িয়ে আছে। দিলরুবা চারদিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে বলল-কবুল! মামার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। দিলরুবার মাথায় মামা হাত বুলিয়ে বলল-আল্লাহ তোমাকে সুখে রাখুক। তোমার জন্য রইল দোয়া। দিলরুবা তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। তার আশপাশেও কিছু মানুষের কান্নার শব্দ শুনা যাচ্ছে। দিলরুবা কান্নায় দু’নিয়ম অবলম্বন করল। বেশ শব্দ করে,যে কান্নায় পুরো বাড়ি কেঁপে উঠার মতো,আবার মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। কান্নার পদ্ধতি হলো এই দুটাই! একটু বিশ্রাম নিয়ে কাঁদলে আরো বেশি শব্দ করে কাঁদা যায়। এই বিশ্রাম-ই আপনি কতক্ষণ একনাগাড় কাঁদতে পারেন তার উপর ভর করবে। না হয় আপনার কান্না থেমে যাবে। ভিতর থেকে আর কান্নার শব্দ বের হবে না। চোখের পানিও শুকিয়ে আসবে।

বাবা-মা মরা মেয়েটার একমাত্র অভিভাবক মামা। তার জন্মের মাসখানেক আগে বাবা মারা যায়। জন্মের একদিন পরে মা। ডাক্তার আগেই বলেছিলেন-এই বাচ্চাটা জন্মদানে অনেক ঝুঁকি আছে মায়ের। অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। তখনও কিন্তু মায়ের মুখে সহজ সরল ভাব ছিল। হাসি মায়ের মুখে লেগেই ছিল। বিষণ্নতার রেখা তার মধ্যে ফুটে উঠে নি। তিনি নামাজ পড়ে দুই হাত তুলে প্রাণ খুলে আল্লাহ কাছে দোয়া করতেন। আল্লাহ যেন তার সন্তানকে হেফাজত করেন। কোনোরকম যেন ঝুঁকি না হয় সন্তানের। সবকিছু যেন তার গায়ের উপর বয়ে যায়। হোক না তার মৃত্যু। তবুও সন্তান বেঁচে থাকুক। তার শেষ ইচ্ছা ছিল-সন্তানের মুখ এক নজর দেখে যেতে। যার জন্য এত কষ্ট,তাকে এক নজর দেখলেই যেন প্রাণ ফেরে। মায়েরা এমনই হয়। হ্যাঁ মায়েরা এমন!

বাবা মায়ের স্মৃতি দিলরুবার জীবনে কিছুই নেই। জন্মের পর মাকে একদিনের জন্য চোখ মেলে দেখার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু সেটা এই মুহূর্তে মনে পড়া একেবারে অসম্ভব। ছোট্ট থেকে সে মামা মামির মুখ দেখে বড় হয়েছে। মামা মামি তাকে নিজের মেয়ের মতো লালনপালন করে তিলে তিলে বড় করেছে। দিলরুবার কাছে তার বাবা মায়ের বিয়ের একটা ছবি ছিল। ছবিটা সে পরম যত্নে বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখত। বিয়ের দিনতারিখ পাকাপোক্ত হওয়ার পর,ঘরদোর পরিষ্কার করার সময় ছবিটা কোথায় যেন হারিয় যায়। দিলরুবা অনেক খুঁজেছে কিন্তু পায়নি। বাবা মায়ের শেষ স্মৃতি হারানোর ব্যথা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। বুক,পাথরের নিচে চাপা পড়ে আছে। মন সমুদ্রে উত্তাল ঢেউ সব লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে।

ছবি হারানোর কথা দিলরুবা কাউকে বলে নি। এমনকি তার মামাকেও না। সেটা সে সবার থেকে গোপন করেছিল। বিয়ের সময় মেয়েরা স্থানচ্যুত হয়। শিকড়-নাড়া হয়। অপরিচিত জায়গায় রোপন হয়। আবার অদ্ভুতভাবে জীবিতও হয়ে যায়। মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখে। পায়ের নিচে বিশাল জায়গা করে নেয়। দিলরুবা স্বাভাবিক থেকে একটু বেশিই কান্না করছে। কী নিয়ে সে বাকি জীবন কাটাবে! ছবিটা যে হারিয়ে গেছে। ছবিটা বুকের মধ্যে চেপে ধরলে শান্তি লাগত। মনকে এই সেই বলে বুঝানো যেত। ছবিটাতে বাবা মায়ের হাসি মুখ ছিল। বাবার গায়ে একটা সাদা শার্ট আর মায়ের পরনে একটা নীল শাড়ি ছিল। দেখেই বুঝা যাচ্ছে মায়ের প্রিয় কালার ছিল নীল। ছবিটা থেকে দিলরুবা তার প্রিয় রং আবিষ্কার করে! তা হলো-নীল।

দিলরুবা কেন এত কান্না করছে মামা কিছুটা ধারণা লাভ করতে সক্ষম হলো। দিলরুবার হাত আজ খালি দেখাচ্ছে। এই খালি জায়গাটা একমাত্র ছবিটাই পূর্ণ করত। ভরাট হয়ে তার হাতে থাকত। কতবার দেখত ছবিটা তার হিসেব নেই। ছবিটা দিলরুবার জীবনে আয়না হয়ে ছিল। যেখানে সে বারবার,একটু পরপর মুখ দেখত। তাছাড়া ছবিটা ছিল দিলরুবার হাসির মাধ্যম। মামা সব বুঝতে পারল। এত কান্নার কারণ। মামা,মামার রুমে লুকানো খামটা এনে দিলরুবার সামনে ধরল। দিলরুবা হাত বাড়িয়ে নিয়ে খামটা খুলে দেখতে লাগল। চার পাতায় আঁকাবাঁকা লেখার প্রথম শব্দ-“তোমার”। দ্বিতীয় শব্দ-“মা”। প্রথম বাক্য -তোমার মা বলছি!

দিলরুবা প্রথম বাক্য দেখে হকচকিয়ে উঠল। তারপর মামার মুখের দিকে তাকালো। মামা বলল-হ্যাঁ, তোমার মায়ের চিঠি। যেটা লেখা হয়েছিল তোমার জন্মের একসপ্তাহ আগে। তোমার মায়ের মৃত্যুর আটদিন আগে। অনেক কষ্টে হাসপাতালের বেড়ে শুয়ে শুয়ে লেখাটা শেষ করেছে তোমার “মা”। লেখাটা আদৌ শেষ হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। কিংবা এটাকে কী শেষ বলে! এই বলে মামা চোখের পানি মুছতে লাগল। এতক্ষণে চোখের পানি তার নির্দিষ্ট গন্ডি অতিক্রম করল। মামা আবার বলতে শুরু করল,বিয়ের সময় চিঠিটা তোমাকে দিতে বলা হয়েছে। কী লেখা আছে পড়ে দেখতে পারো। মামা বলার আগেই দিলরুবা প্রায় দুই পৃষ্ঠা পড়ে শেষ করে ফেলল।

পুরোটা চিঠি চোখের পলকে পড়ে শেষ করে ফেলল! ধারণা করা হচ্ছে, চিঠিটা পড়তে মাত্র কয়েকবার নিঃশ্বাস নেয়া হয়েছে! আসলে এটা কী করে সম্ভব হয়! কতটা তীব্র আগ্রহ থাকলে এমনটা সম্ভব? এমন আগ্রহ মাপার কোনো যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে কী? দিলরুবা চিঠিটার দিকে একনজর তাকিয়ে আছে। “ওমা”, বলে চিৎকার দিয়ে উঠল। এই চিৎকারের ভাষা কেউ বুঝে না। শুধু মুখে উচ্চারিত শব্দ শুনা যাচ্ছে। কান্নার পানি কেউ মুছছে না। শুধু সবাই তাকিয়ে আছে। চিঠিতে কী লেখা হয়েছিল, সবার অজানা। জানে শুধু দিলরুবা, তার মৃত মা,আর তার মামা!

দিলরুবার আরো বেশি শব্দে চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে- “হারানো ছবি,ফিরে পাওয়া চিঠি”! আমার মায়ের প্রতিচ্ছবি! আমার মায়ের স্মৃতি! মা,ওগো মা,তুমি আজ আমার সামনে! হ্যাঁ তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছো তবুও আমি তোমাকে দেখতে পারছি না। তুমি কোথায়?মা,ওগো মা। চিঠিতে তুমি বলেছিলে আমার বিয়ের সময় তুমি আসবে, আমার সামনে। মা,ওগো মা। তুমি কী ওপার থেকে আমাকে দেখতে পাচ্ছ! বলো না মা,প্লিজ একটু বলো মা!

 

লেখক,

ছাত্র, বসুরহাট ইসলামিয়া ফাযিল মাদরাসা, নোয়াখালী

Hot this week

নীল শাড়ি রূপা আর এক হিমালয়ের হিমু

সেদিন হিমালয় থেকে হিমু এসেছিল। মো. মোস্তফা মুশফিক তালুকদার। মাথার উপর...

সিজিপিএ বনাম অভিজ্ঞতা — মাহফুজা সুলতানা

বন্ধু, তোমার সিজিপিএ আমায় ধার দিও। বিনিময়ে,আমার থেকে অভিজ্ঞতা নিও।...

‘দেবী’কথনঃ একটু খোলামেলাই!

জুবায়ের ইবনে কামাল আপনি কি দেবী সিনেমা নিয়ে আমার মতই...

শরৎকাল: কাশের দেশে যখন প্রকৃতি হাসে !

ইভান পাল || আজ কবিগুরুর একটা গান ভীষণ মনে পড়ছে--- "আজি...

মাওঃ সাদ সাহেবের যত ভ্রান্ত উক্তি

বেশ কিছুদিন যাবৎ মাওঃ সাদ সাহেবকে কেন্দ্র করে তাবলীগ...

আইএসপিএবি ২০২৫ নির্বাচনে আমিনুল হাকিমের নেতৃত্বে ‘আইএসপি ইউনাইটেড’ প্যানেল

আসন্ন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) ২০২৫–২০২৭...

বাংলাদেশ থেকে ১.৫ মিলিয়ন টন আম নিতে আগ্রহী চীন

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার কেন্দুয়া ঘাসুড়া এলাকার একটি রপ্তানিযোগ্য আমবাগান...

‘স্টারলিংক‘-এর লাইসেন্স অনুমোদন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা

যুক্তরাষ্ট্রের এনজিএসও সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘স্টারলিংক‘-এর লাইসেন্স অনুমোদন করেছেন প্রধান...

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরপিএল: সম্ভাবনা ও গুরুত্ব

আরপিএল বর্তমান বিশ্বে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের জন্য প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি...

কালীগঞ্জে শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে অভিভাবক সমাবেশ

গাজীপুরের কালীগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী ‘নরুন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে’ শিক্ষার মানোন্নয়নের...

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন শফিক রেহমান

দৈনিক যায়যায়দিনের ডিক্লারেশন ফিরে পেলেন বর্ষিয়ান সাংবাদিক শফিক রেহমান।...

ভারতের নাগপুরে হিন্দুত্ববাদীদের তাণ্ডব, কারফিউ জারি

ভারতের নাগপুরে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানোর দাবিতে বিক্ষোভের...

বিয়ের কাজ সারলেন তালাত মাহমুদ রাফি

বিয়ে করেছেন সমন্বয়ক তালাত মাহমুদ রাফি। সোমবার (১৭ মার্চ)...
spot_img

Related Articles

Popular Categories

spot_imgspot_img