বিশ্বজুড়ে হেপাটাইটিস বি (HBV) ভাইরাস একটি নীরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত, যা মূলত রক্ত ও দেহের অন্যান্য তরলের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। এটি একটি মারাত্মক লিভার সংক্রমণ, যা আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ২৯৬ মিলিয়ন মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত এবং প্রতিবছর প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষ নতুন করে এই ভাইরাসে সংক্রমিত হন।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস কীভাবে কাজ করে
হেপাটাইটিস বি দুই ধরনের হতে পারে — অ্যাকিউট (স্বল্পমেয়াদি) এবং ক্রনিক (দীর্ঘমেয়াদি)। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সংক্রমণ নিজে থেকেই সেরে যায়, তবে শিশুরা যদি আক্রান্ত হয়, তাহলে প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই এটি দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেয়।
হেপাটাইটিস বি-এর সাধারণ লক্ষণসমূহ
ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করার পর অনেক সময় কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে:
অস্বাভাবিক ক্লান্তি ও দুর্বলতা
জ্বর ও মাথাব্যথা
বমি, ক্ষুধামান্দ্য এবং পেটব্যথা
গা ও চোখে হলদে ভাব (জন্ডিস)
বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই লক্ষণগুলো আরও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
সংক্রমণের পথ ও ঝুঁকি
হেপাটাইটিস বি প্রধানত নিম্নলিখিত পথগুলোতে ছড়ায়:
অনিরাপদ যৌনসম্পর্ক
রক্তবাহিত জিনিস (যেমন রেজার, ইনজেকশন, নখ কাটার) শেয়ার করা
মায়ের শরীর থেকে নবজাতকের দেহে
ট্যাটু বা পিয়ার্সিংয়ের সময় জীবাণুমুক্ত উপকরণ ব্যবহার না করা
সংক্রমিত রক্ত গ্রহণ
তবে কাশি, হাঁচি, একসাথে খাওয়া বা চুম্বনের মাধ্যমে ভাইরাসটি সংক্রমিত হয় না।
ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী
নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস বি সংক্রমণের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি:
স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা
ইনজেকশন ড্রাগ ব্যবহারকারীরা
ডায়ালাইসিস রোগী
সংক্রমিত ব্যক্তির যৌনসঙ্গী
গর্ভবতী নারী, MSM (পুরুষ-পুরুষ সম্পর্ককারী)
চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা
হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের কোনও নির্দিষ্ট স্থায়ী চিকিৎসা নেই, তবে দীর্ঘমেয়াদে ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিছু অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী যে ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে:
পেগইন্টারফেরন আলফা-২এ (Pegasys)
এনটেকাভির (Entecavir)
টেনোফোভির (Tenofovir)
লামিভুডিন, অ্যাডেফোভির, টেলবিভুডিন
ক্রনিক রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসার পাশাপাশি লিভারের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা, আল্ট্রাসনোগ্রাফি এবং লিভার বায়োপসি করা হয়।
গর্ভাবস্থায় হেপাটাইটিস বি ও নবজাতকের নিরাপত্তা
HBV পজিটিভ গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে নবজাতকের সংক্রমণের আশঙ্কা অত্যন্ত বেশি। জন্মের ১২ ঘণ্টার মধ্যে নবজাতককে হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন এবং ইমিউনোগ্লোবুলিন দেওয়া হলে সংক্রমণের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। তা না হলে, শিশুটির মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
প্রতিরোধ ও টিকাদান কর্মসূচি
হেপাটাইটিস বি থেকে সুরক্ষার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ভ্যাকসিন গ্রহণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (CDC) অনুযায়ী, প্রতিটি শিশুকে জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন দিতে হবে। পূর্ণ কোর্সে সাধারণত ৩টি ডোজ (প্রথম, এক মাস পর, ছয় মাস পর) দেওয়া হয়।
১৯ থেকে ৫৯ বছর বয়সী প্রতিটি ব্যক্তি এবং উচ্চঝুঁকিতে থাকা সব গোষ্ঠীকে টিকা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়।
ভুল ধারণা ও সামাজিক সচেতনতা
সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও অনেক ভুল ধারণা রয়েছে হেপাটাইটিস বি নিয়ে। অনেকেই মনে করেন এটি ছোঁয়াচে, যা বাস্তব নয়। এই ভাইরাস শুধুমাত্র নির্দিষ্ট দেহ তরলের মাধ্যমে ছড়ায় এবং এটি কোনো সামাজিক কলঙ্ক নয়। যথাযথ সচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এই ভাইরাস থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব।
উপসংহার
হেপাটাইটিস বি একটি ভয়ঙ্কর সংক্রমণ হলেও সচেতনতা, প্রাথমিক স্ক্রিনিং এবং টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে এটি প্রতিরোধযোগ্য। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের উচিত নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের রক্ত পরীক্ষা করানো, ঝুঁকি থাকলে চিকিৎসা গ্রহণ করা এবং ভ্যাকসিন নেওয়া।
তথ্যসূত্র:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC)
ল্যানসেট পাবলিক হেলথ রিপোর্ট