বদরুল ইসলাম
বাংলাদেশের কোটি কোটি তরুণ শিক্ষিত হচ্ছেন, স্বপ্ন দেখছেন একটি সরকারি চাকরির। তারা বিশ্বাস করেন, রাষ্ট্রের চাকরিতে নিয়োজিত হয়ে দেশ ও সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারলে সেটিই হবে জীবনের সার্থকতা। কিন্তু এই স্বপ্ন অনেকের জন্যই পূরণ হয় না, শুধুমাত্র একটি কারণেই—সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা মাত্র ৩০ বছর।
বর্তমান বাস্তবতায় বয়সসীমা ৩০ বছর রাখা এক ধরনের বৈষম্য, যা সময় ও বাস্তবতা দুটোই অস্বীকার করে। এই নিয়ম আমাদের তরুণ সমাজকে হতাশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাই সময় এসেছে এই নীতিমালার সংশোধন করে সরকারি চাকরিতে আবেদনের সর্বোচ্চ বয়সসীমা অন্তত ৩৫ বছর করার। এই পরিবর্তন শুধু সময়োপযোগী নয়, বরং ন্যায্য, মানবিক ও বাস্তবসম্মত।
দীর্ঘ শিক্ষা জীবন ও সেশনজট: সময় কেড়ে নেয়
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে একটি শিক্ষার্থীর জীবনের প্রায় ২৫-২৮ বছর লেগে যায়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেশনজট, আন্দোলন, বন্ধ বা পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রতা শিক্ষাজীবনকে অনেক ক্ষেত্রে আরও দীর্ঘ করে তোলে। বিশেষ করে যারা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি (মাস্টার্স) শেষ করেন, তাদের ক্ষেত্রে বয়স হয় প্রায় ২৮ বা ২৯। তারপরই শুরু হয় বিসিএস বা অন্যান্য সরকারি চাকরির প্রস্তুতি। মাত্র এক থেকে দুই বছরের সময় পেয়ে তারা অনেকেই পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে পারেন না, আর বয়সসীমার কাঁটায় হারিয়ে যায় তাদের স্বপ্ন।
কোভিড-১৯ ও অন্যান্য সংকট: জীবনের অনিবার্য থেমে যাওয়া
বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারির সময় অনেক তরুণ দীর্ঘ সময় পড়াশোনা ও পরীক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। অনেকে পরিবারের আর্থিক সংকটে চাকরি খুঁজে বেড়িয়েছেন, কিন্তু সরকারি চাকরির বয়সসীমা তাদের সেই সুযোগ দেয়নি। অথচ এই সময়ে যারা কিছু সময় হারিয়েছেন, তারা এখনো মেধা ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তাই অতীতের ক্ষতিপূরণ হিসেবে, এবং ভবিষ্যতের জন্য নীতিমালাকে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে এখনই প্রয়োজন বয়সসীমা বাড়ানো।
পরিপক্বতা ও অভিজ্ঞতা: বয়সের সাথে আসে দায়িত্বশীলতা
৩০ বছরের নিচে একজন চাকরিপ্রার্থীর মানসিকতা ও জীবনদৃষ্টির মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা থাকে। ৩৫ বছর বয়সী একজন ব্যক্তি অনেক বেশি পরিণত, বাস্তবতা-অনুভবী এবং দায়িত্ববান। তিনি কেবল নিজের নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিও দায়িত্বশীল হয়ে ওঠেন। তাই বয়স বাড়া মানেই দুর্বলতা নয়—বরং এটি দক্ষতা, ধৈর্য ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক। রাষ্ট্র চাইলে এই পরিণত মনোভাবসম্পন্ন নাগরিকদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে পারে।
বেকারত্ব ও হতাশা: তরুণ সমাজের চাপ বাড়ছে
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) অনুসারে, দেশে প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষিত তরুণ-তরুণী বেকার। তারা চাকরি খুঁজছেন, প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কিন্তু এক পর্যায়ে এসে বয়সসীমার দেয়ালে আটকে যাচ্ছেন। এই সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে, কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া তরুণদের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু সরকারি চাকরির জন্য প্রার্থিতার সময়সীমা অপরিবর্তিত থাকছে। এই ব্যবধান থেকেই জন্ম নিচ্ছে হতাশা, মাদকাসক্তি, সামাজিক অবক্ষয় এবং আত্মহননের মত মর্মান্তিক ঘটনা।
আন্তর্জাতিক তুলনা: বাংলাদেশ পিছিয়ে
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরকারি চাকরির জন্য বয়সসীমা বাংলাদেশ থেকে অনেক বেশি। যেমন: ভারত: বেশিরভাগ সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা ৩৫-৪০ বছর। পাকিস্তান: ৩৫ বছর পর্যন্ত আবেদন করা যায়, কিছু ক্ষেত্রে ৪০ বছরও। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন: ৩৫ বছরের ওপরে আবেদনযোগ্যতা রয়েছে। বাংলাদেশ যদি টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে চায়, তবে এ ধরনের আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করা জরুরি।
বিশেষ নিয়োগে বয়স ছাড়: তবে স্থায়ী নীতির প্রয়োজন
যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন, কোভিড-১৯ সংকটে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিশেষ বয়স ছাড় দিয়েছে সরকার, যা ইতিবাচক দৃষ্টান্ত। তবে এই ছাড় যেন স্থায়ী নীতিতে পরিণত হয়, সেটাই সময়ের দাবি। শুধু বিশেষ পরিস্থিতির জন্য নয়, প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি মানবিক ও ন্যায্য সুযোগ থাকা উচিত। এখনই সময় সিদ্ধান্তের সরকারি চাকরির বয়সসীমা অন্তত ৩৫ বছর করা হলে— তরুণরা সময়মতো প্রস্তুতি নিতে পারবে, উচ্চশিক্ষিত, অভিজ্ঞ নাগরিকরা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে সুযোগ পাবে, বেকারত্ব ও হতাশা কমবে, রাষ্ট্র পাবে দক্ষ ও পরিপক্ব কর্মীশক্তি। সরকারি চাকরি কেবল একটি চাকরি নয়, এটি একজন নাগরিকের আত্মমর্যাদা, দায়িত্ব ও সম্ভাবনার প্রকাশ। এই সুযোগ যাতে বয়সের কারণে ঝরে না যায়, সেটাই হোক রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাই বলতেই হয়— “সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছর করা এখন সময়ের দাবি, জনগণের দাবি, এবং উন্নয়নমুখী রাষ্ট্র গঠনের অপরিহার্য পদক্ষেপ।”
লেখক: সাংবাদিক, বরগুনা