শুনতে খারাপ লাগলেও এটিই সত্যি যে অতি শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারে সন্তান নষ্ট হওয়ার পিছনে প্রধান দায়টা মা-বাবারই।
এই উচু শ্রেণীর অতি শিক্ষিত পরিবারে মূলত দুই রকম বাবা-মা দেখা যায়। একদল নিজের অর্থবিত্ত আর স্যোশাল স্ট্যাটাসের ভারে সন্তানের জন্য ন্যূনতম সময়টুকু দেয়ারও সময় পায়না ফলে তারা নিজের মত লাগামছাড়াভাবে চলে। আর আরেকদল সন্তানকে “স্যোশাল স্ট্যাটাস” কিনে দেয়ার গুরুদায়িত্ব দিয়ে সবসময় আতংকে রাখে।
প্রথম শ্রেণীর সন্তান খারাপ হবেই এটা স্বাভাবিক, এটা নিয়ে নতুন করে বলারও কিছু নেই। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণী সন্তানকে লাগামের মধ্যে রেখেও যে কিভাবে তাদের ক্ষতি করছে সেটাই হচ্ছে আলোচ্য বিষয়, যা নিয়ে অনেক মা-বাবাই ভাবেন না।
সবার একটা সামর্থ্য আছে। হয়তো আপনার সন্তানটা একটু কম মেধাবী, চেষ্টা করা সত্ত্বেও ক্লাসে প্রথম হতে পারে না কিন্তু সে তার সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করে। এক্ষেত্রে আপনি তার চেষ্টাটাকে না দেখে “কেন প্রথম হতে পারল না” এই অভিযোগেই কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। এর প্রভাব কিন্তু সব সময় ভালো হবে না।
আপনার পাশের বাসার প্রতিবেশী ভাবী বা অফিসের কলিগের বাচ্চা ক্লাসে ফার্স্ট হইছে আপনার বাচ্চা পারেনি এতে করে আপনার মান সম্মান শেষ! বাসায় ফিরে বাচ্চাকে ইচ্ছেমত বকলেন। তার মনের মধ্যে শুরুতেই “আমি ব্যার্থ, আমি অযোগ্য” এমন একটা চিন্তা ঢুকিয়ে দিলেন; এর প্রভাব কিন্তু একটু হলেও খারাপ হবে।
আপনার বাচ্চা অমুক জায়গায় চান্স পায়নি ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট হয়নি এজন্য আপনার সমাজে মুখ দেখানো দায় হয়ে গেল!
আচ্ছা একটা ক্লাসে ফার্স্ট তো সবাই হবে না, একজনই হবে। তো আপনারা সবাই যদি চান সবার সন্তান ফার্স্ট হবে এটা কিভাবে সম্ভব? আর এতে করেই যদি সে ব্যার্থ হয়, আপনার ইজ্জত ডুবায় তাহলে তো ক্লাসের যেই একজন ফার্স্ট হয় সে ছাড়া বাকি সবাই ব্যার্থ সবাই অযোগ্য!
একটা ভার্সিটিতে হাজার হাজার স্টুডেন্ট সব ডিপার্টমেন্ট মিলিয়ে নাহয় শ’খানেক ছেলেমেয়ে আছে যারা তাদের ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড। তাহলে আপনাদের কথামত তো ওই শ’খানেক বাদে পুরো ভার্সিটিই অযোগ্যদের দখলে, এরা সবাই ভবিষ্যতে না খেয়ে থাকবে।
আপনার ছেলে কথামত চলে, মনযোগের সাথে পড়াশুনা করা সত্ত্বেও ফার্স্ট হতে পারেনি এটা শুধু ওর ব্যার্থতা না এটা আপনারও ব্যার্থতা যে আপনি ওকে এমন জায়গায় পড়াতে পারেননি যেখানে এক ক্লাসে একাধিক স্টুডেন্ট ফার্স্ট হয়। তাই ওকে বলার আগে আপনি তেমন স্কুল খুজে দেন।
আপনার মেয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় দিনরাত খেটেও চান্স পেল না। এখানে শুধু ও একাই চান্স পায়নি এমন না, ওর মত আরো অনেকেই পায়নি, অনেকেই বলতে কেউই পায়নি হাতে গোণা কয়েকজন ছাড়া। বাকি সবাই বাদ পড়েছে তার মানে সবাই খারাপ?
বাচ্চা ভার্সিটিতে কেন চান্স পায়নি এই দায়ে তাকে অপমান করার আগে এমন ভার্সিটি খুঁজে দেন যেখানে যারা যোগ্য তারা সবাই ভর্তি হতে পারবে, সবার জন্য পর্যাপ্ত আসন আছে।
“অমুকের মেয়ে নাসার বিজ্ঞানী”, “তমুকের ছেলে গুগলে জব করে”, “অমুকের বাচ্চা ওই স্কুলে চান্স পেয়েছে”, “তমুকের বাচ্চা ক্লাসে ফার্স্ট, ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে”- এসব বলে সন্তানকে বকা দিয়ে লজ্জা ও অপমানের চূড়ান্ত সীমা দেখিয়ে দিলেন।
তাহলে একইভাবে বলাই যায় “অমুকের বাবা অমুক কোম্পানীর এমডি আর আপনি সামান্য ম্যানেজার”, “তমুকের বাবা বিল গেটস মাইক্রোসফটের মালিক আর আপনি কি?”
এগুলো কি কখনও আপনার সন্তান বলছে? বলেনি। সন্তান হয়ে বাবাকে এসব বলাটা যেমন বেয়াদবির এবং আপনার জন্য অপমানের তেমনি নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরেও সামান্য উনিশ-বিশ হওয়াতেই মা-বাবার কাছ থেকে এভাবে অপমানিত হওয়াটাও সন্তানের জন্য কম কষ্টের না।
আপনি যেমন কলিগের ছেলের গল্প দিনের মধ্যে নিয়ম করে তিনবেলা শোনান আর ছেলেকে অপমান করেন সেভাবে ছেলে যদি আপনাকে বলে কলিগের ঢাকায় তিনটা ফ্ল্যাট আপনার একটা কেন?
আপনি যেমন পাশের বাসার ভাবীর মেয়ের গল্প উঠতে বসতে মেয়ের কানে বাজান সেভাবে মেয়েও যদি বলে ওই আন্টি মাষ্টার্স পাশ আপনি অনার্স কেন?
তখন পারবেন নিজেকে সামলাতে?
আপনি ভার্সিটির প্রফেসর তাই আপনার মেয়ে ক্লাসে ফার্স্ট না হলে আপনার সম্মান শেষ, একইভাবে মেয়েটা যদি বলে অমুকের বাবা ভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর তাই আমার বাবাও ভাইস চ্যান্সেলর না হলে আমার ইজ্জত শেষ, এই বাবাকে নিয়ে সমাজে মুখ দেখাতে পারব না, আমার স্ট্যাটাস টিকবে না।
তখন কি করবেন?
আপনি শিক্ষক তাই আপনার ছেলেকেও সিজিপিএ ৪ এ ৪ পেয়ে শিক্ষক হতেই হবে না হলে সে আপনার ব্যার্থ সন্তান, সমাজে আপনার মুখ থাকবে না। একইভাবে ছেলে যদি বলে, আমি প্রোগ্রামিংয়ে দেশসেরা অথচ আমার বাবা হয়ে তুমি প্রগ্রামিং পারো না, তোমাকে শিক্ষকতা ছেড়ে প্রোগ্রামিংয়েই ক্যারিয়ার গড়া লাগবে নাহয় ছেলে হিসেবে সমাজে আমার মুখ থাকবে না!
তখন কি করবেন?
সর্বোপরি একটা কথা না বললেই নয়, মা-বাবার অবস্থান সবার উপরে, তাদের ছোট করার স্পর্ধাও আমাদের নেই। মা-বাবা সন্তানকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে একথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সন্তান ভুল করলে অবশ্যই মা-বাবা শাসন করবে, বকা দিবে, প্রয়োজনে মারবেও; এসব নিয়ে আপত্তির কিছু নেই।
কিন্তু যখন আপনার সন্তান নিজেই আপনার কথামত চলে, নিজের সর্বোচ্চ ডেডিকেশন দিয়ে পড়াশুনা করে, কোন বাজে কিছুর মধ্যে যায়না; এই অবস্থার পরেও যদি আপনার আশানুরূপ ফলাফল সে করতে না পারে সেক্ষেত্রে তার প্রতি বৈরী আচরণ করাটা বেশিই বাড়াবাড়ি।
সে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে ভাল কিছু করার পরেও “আরো ভাল কেন করল না” এই দায়ে বকলেন, মোটিভেট ও ইন্সপায়ারড না করে উল্টো তার মনের মধ্যে “সে অযোগ্য, ব্যার্থ, তার দ্বারা কিছুই সম্ভব না, সে পরিবারের লজ্জার কারন” এই ধরনের ধারনা তৈরী করে দিলেন।
এরপর কিন্তু যেহেতু চেষ্টা করেও হয়না এবং সে ব্যার্থ এই চিন্তা করে আপনার সন্তান আরো ভাল করে চেষ্টা না করে বরং একদম হাল ছেড়ে দেয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু না।
আপনি হয়তো আশা করছেন কিন্তু আপনার ছেলেটা বা মেয়েটা কিন্তু আশার সাথে সাথে পরিশ্রমও করছে। তাই প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল না পাওয়ার কষ্টটা আপনার চাইতে তার কয়েকগুণ বেশি। এই অবস্থায়ও তাকে সাপোর্ট না দিয়ে যদি অপমান করেন তাহলে সে ভুল করে ডিপ্রেশন কাটানোর মাধ্যম হিসেবে নেশা করা শুরু করলে দায়টা আপনারই।
ছেলে ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়নি তবে মোটামুটি সম্মানজনক ফলাফল করেছে কিন্তু তার মনের মধ্যে আপনি আগেই এমন একটা ভয় গেঁথে দিয়েছেন যে সে রেজাল্ট বলার সাথে সাথেই বাসায় তাকে বাবা-মা মিলে লজ্জা ও অপমান দিয়ে মাটিচাঁপা দিবে, এই চিন্তায় অন্যমনষ্ক হয়ে আপনাদের অপমানের চাপা খাওয়ার আগে রাস্তায় গাড়িচাপা পরলেও সেটা অস্বাভাবিক না। এসব ভয়ে বাড়ি না ফেরা, পালিয়ে যাওয়া বা সুইসাইড করলেও তার দায়টা পরিবারের উপর অবশ্যই বর্তায়।
সত্যি বলতে অতি শিক্ষিত এবং হাই সোসাইটি ও স্ট্যাটাস বজায় রাখা মানুষদের এই অতিরিক্ত স্ট্যাটাসবাজিই তাদের সন্তান নষ্ট হওয়া, নেশা করা, সুইসাইড করা, ডিপ্রেসড হওয়া এসবের পিছনে অন্যতম প্রধান কারন।
আপনার স্ট্যাটাস বজায় রাখার সম্পূর্ণ দায়িত্ব সন্তানের কাধে চাপানোর আগে আপনার ভালবাসার হাতটি তার কাধে রাখুন, তার সাথে কথা বলুন, বন্ধুসুলভ আচরন করুন, তার সাথে সব শেয়ার করুন, তার কথা শুনুন।
সন্তানের সাথে আপনার কমিউনিকেশন এপ্রোচটাই অনেক বড় একটা প্রভাব ফেলতে পারে তার উপর। তাকে আশাবাদী হতে শেখান, মোটিভেট করুন। “আমি পারি না” এই ব্যার্থতার মনোভাব না গড়ে “আমি পাড়ব” এই মনোভাব তার মধ্যে তৈরী করুন। “অমুক পারল তুমি কেন পারলে না” এভাবে না বলে বলুন “অমুক যেহেতু পেরেছে তুমিও পারবে, চেষ্টা চালিয়ে যাও”।
আপনার এই সামান্য কথার পার্থক্যের কারনে তার মনোভাবে বিশাল পরিবর্তন আসবে।
সন্তানকে স্যোশাল স্ট্যাটাস তৈরীর একমাত্র মেশিন হিসেবে কাজে লাগিয়ে শুধুই পড়াশুনা, রেজাল্ট, ক্যারিয়ার এসব দেখতে দেখতে নিজের সন্তানটাই যে মানসিকভাবে মারা যাচ্ছে তা কি একবারও দেখেছেন? নাকি তা ভাবার সময় নেই? সন্তান ফার্স্ট হলেই চলবে সেই সম্মান দিয়েই চলবে, সন্তান মারা গেলে যাক!
সন্তানকে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলুন, কোন স্যোশাল স্ট্যাটাস তৈরীর যন্ত্র হিসেবে না। সন্তান মানুষ হলে স্যোশাল স্ট্যাটাস এমনিই হয়ে যাবে। আর “মানুষ” হওয়া মানে অবশ্যই শুধুমাত্র ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া না। 🙂
লেখকঃ নাজমুল হাসান
প্রোগ্রাম কোর্ডিনেটর
নাইফা মারুফ ফাউন্ডেশন