– হাসান ইনাম
ধরুন, আমি ধার্মিক একটা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। শৈশব থেকেই আমি কঠোর অনুশাসনের মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছি। আমাকে ধর্মীয় বই পুস্তক ছাড়া অন্য কোনো বই পড়তে দেওয়া হচ্ছে না। আমাকে বলা হচ্ছে গল্প-উপন্যাস-সায়েন্স ফিকশনে নাস্তিক্যবাদের বীজ বপন করা থাকে। ওসব বই পড়লে ঈমান থাকে না। আর স্বভাবতই মানুষ নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি বেশীকৌতূহলী হয়। সুযোগ পেলেই আমি সেসব তথাকথিত নিষিদ্ধ বই পড়ে ফেললাম আর খুঁজে খুঁজে নাস্তিক্যবাদ চিহ্নিত করলাম।
আমাকে শেখানো হলো ধর্ম মানেই জঙ্গিবাদ। ধর্ম মানেই গোঁড়ামি। ধর্ম মানেই সব কঠোরতা। তাই আমি ধর্মকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম। যথাসম্ভব ধর্ম থেকে দূরে থাকলাম।
আবার ধরুন, আমি মডার্ন অর সেমি মডার্ন মুসলিম ফ্যামিলিতে জন্মগ্রহণ করলাম। আমার ফ্যামিলিতে তেমন চাপ নেই। যা খুশি করি। যেমন খুশি চলি। তবে আমাকে শেখানো হলো ধর্ম মানেই জঙ্গিবাদ। ধর্ম মানেই গোঁড়ামি। ধর্ম মানেই সব কঠোরতা। তাই আমি ধর্মকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম। যথাসম্ভব ধর্ম থেকে দূরে থাকলাম।
দুটো চিত্রই সহনীয় পর্যায়ের। এমনটা হয়ে আসছিল দুই হাজার তেরো পর্যন্ত। এর মাঝের সময়েও যে বাড়াবাড়ি ছিল না সেটা বলছি না। ছিল তবে সহনীয় পর্যায়ে। কিন্তু এই সময়টাতে এসে দুটো গ্রুপই এ্যকশনে চলে গেল। তবে সেটা সাময়িক। সাময়িক বলছি কারণ, যে উদ্দেশ্যে দুটো জনরা তৈরি হয়েছিল সে উদ্দেশ্যে জনরা দুটো বেশিদিন কাজ করতে পারলো না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা অন্যান্য দিকে ব্যবহার হতে লাগলো জনরা দুটো। এখন এই দুই জনরা আসলে কোন উদ্দেশ্যে তৈরি হলো বা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে শেষ হলো সেটা নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই না।
এই জনরা দুটো তাদের উদ্দেশ্য সাধনে কতটুকু সফল সেটাও বলতে চাই না। এতটুকুই বলতে চাই যে ঐ সময়টার পর সমাজে পুরনো বৈষম্যে নতুন মাত্রা যোগ হলো।
ইসলাম নিয়ে কথা বললে তুমি হেফাজতী। ইসলামের বাইরে কথা বললে তুমি শাহাবাগী। হেফাজত মানে গোঁড়ামি। আর শাহাবাগ মানে নাস্তিকতা।
এই সময়ের আগেও বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার চর্চা হতো। মানুষজন ধর্মের অনুশাসন মেনে চলতো। কিন্তু এই সময়টার পর দুটো ট্যাগ লেগে গেল। ট্যাবু তৈরি হলো। আর এই সুযোগটাই নিল তৃতীয় পক্ষ। হ্যাঁ, তৃতীয় পক্ষই।হেফাজত নাস্তিকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। এটা ঠিক। কিন্তু কোনো নাস্তিকের উপর অস্ত্র উঠায়নি।
কারণ ধর্ম কখনই বলে না খুনের কথা। একটা সমাজের সবাইকেই কঠোরভাবে ধর্ম মেনে চলতে হবে এমনটা নয়, আবার একটা সমাজের সবাইকে মুক্তচিন্তা করতে হবে এমনটাও নয়।
ধর্মের দোহায় দিয়ে এক শ্রেণীর কুলাঙ্গার অস্ত্র হাতে নিয়েছে। আর তাঁরা ব্যবহার করছে যুবক শ্রেণিকে। ধর্মকে এসব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা খুবই সহজ। ধর্ম সবথেকে স্পর্শকাতর বিষয়।
হেফাজত নাস্তিকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। এটা ঠিক। কিন্তু কোনো নাস্তিকের উপর অস্ত্র উঠায়নি।
পুরোপুরি যারা ধর্ম মানছে তাদের কেউ কখনই অস্ত্র হাতে নিবে না। সমার্থনও করবে না। তাহলে কারা হাতে নিচ্ছে অস্ত্র?
মডার্ন মুসলিম সমাজটা উভয় ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী। এদের সহজেই ইসলাম বিদ্বেষী করে তোলা যায়। আবার খুব সহজেই অস্ত্র হাতে তুলে দেওয়া যায়। রিসেন্টলি ঘটে যাওয়া কয়েকটা অপ্রীতিকর ঘটনাই তার প্রমাণ বহন করে। ইসলাম প্রাক্টিস করে না অথচ মুসলিম। এমন কাউকে প্রথমে জাহান্নামের ভয় দেখিয়ে ডিপ্রেশনে ফেলা হয়। তারপর বলা হয় শহীদ হলে ডিরেক্ট জান্নাত। তখন তারা জান্নাতে যাওয়ার জন্য শর্টকার্ট ওয়ে পেয়ে যায়। এবং সেদিকেই ছুটে। অথচ জান্নাতে যাওয়ার কোনো শর্টকার্ট ওয়ে নেই।
এই হত্যা, খুন, কোপাকোপির মূল হলো পরিবার। পরিবার থেকে যদি প্রথমেই ইসলাম নিয়ে ভুল তথ্য দেওয়া না হয় তাহলে সে কখনই ইসলাম বিদ্বেষী হবে না। আর যদি মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে বিষেদাগার না করা হয় তাহলে সে কখনই মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে যাবে না।
আর মুক্তচিন্তা মানেই কোনো ধর্মকে আঘাত করা নয়। আর কেউ আঘাত যদি কেউ করে তাহলে সে আঘাত অস্ত্র দিয়ে প্রতিহত না করে যে পথে আঘাত এসেছে সে পথেই প্রতিহত করতে হয়।
এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমার খুব কাছের বন্ধু বলেছিল ‘দাবার কোর্টে দাবা খেলতে হয় পাঞ্জা নয়।’