
বদরুল ইসলাম
যে জাতি আলেমদের অবমাননা করে, তারা ধ্বংস হয়ে যায় আত্মিক ও নৈতিকভাবে।
ইসলাম এমন এক জীবনব্যবস্থা, যেখানে প্রতিটি মানুষের সম্মান রক্ষার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। আর সেই ইসলামকে আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব যাদের ওপর, তারা হলেন আলেম-ওলামাগণ। আলেম মানে কেবল জ্ঞানী মানুষ নয়; তিনি দ্বীনের আলোকে জীবন গঠনের দিশা দেখান। অথচ আজ আমরা এমন এক সমাজে বসবাস করছি, যেখানে কিছু মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা জনসমক্ষে আলেমদের গালি দেওয়া, বিদ্রূপ করা, বা হেয় করে কথা বলাকে ‘সাহস’ মনে করছে! এই প্রবণতা কেবল দীনকে হেয় করা নয়, এটি পুরো সমাজের জন্য ভয়াবহ আত্মিক পতনের ইঙ্গিত।
আলেমদের মর্যাদা কুরআনের ভাষায়
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“আল্লাহকে ভয় করে তার বান্দাদের মধ্যে কেবল আলেমরাই।”
(সূরা ফাতির, আয়াত ২৮)
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট হয়, প্রকৃত আলেম হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি আল্লাহভীতিতে পরিপূর্ণ। এমন একজন মানুষকে গালি দেওয়া মানে আল্লাহভীতির প্রতীককে অপমান করা।
রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৃষ্টিতে আলেমদের মর্যাদা
“আলেমগণ হচ্ছেন নবি গণের ওয়ারিশ।”
(আবু দাউদ, হাদিস: ৩৬৪১)
নবিগণ যেমন মানুষকে সঠিক পথে ডেকেছেন, আলেমগণও তাঁদের সেই দায়িত্বের ধারাবাহিকতা রক্ষা করছেন। তাঁদের গালি দিলে আমরা আসলে কী ও কাকে অপমান করছি, তা ভেবে দেখা দরকার।
ভুল করলে সংশোধন হবে, অপমান নয়
হ্যাঁ, আলেমরাও মানুষ, তাদেরও ভুল হতে পারে। কিন্তু ইসলামী আদব হলো, ভদ্রতা ও প্রজ্ঞার সঙ্গে ভ্রান্তি চিহ্নিত করা—কখনোই অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার নয়। কুরআনে বলা হয়েছে:
“তুমি নিজ প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডাকবে হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে আর (যদি কখনও বিতর্কের দরকার পড়ে, তবে) তাদের সাথে বিতর্ক করবে উৎকৃষ্ট পন্থায়। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক যারা তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, তাদের সম্পর্কে ভালোভাবেই জানেন এবং তিনি তাদের সম্পর্কেও পরিপূর্ণ জ্ঞাত, যারা সৎপথে প্রতিষ্ঠিত।”
(সূরা নাহল, আয়াত ১২৫)
এটা শুধু সাধারণ মানুষ নয়—আলেমদের সম্পর্কেও প্রযোজ্য।
গালি-বিদ্রূপের পরিণতি ভয়ানক
উবাদা ইবনে সামেত (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ওই ব্যক্তি আমার আদর্শের ওপর নাই, যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের আলেমদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান করে না।
আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, বৃদ্ধ মুসলমান কোরআনের আদব রক্ষাকারী ও কোরআন অনুযায়ী আমলকারী হাফেজ এবং ন্যায়পরায়ণ বাদশাহর সম্মান করা মহান আল্লাহর সম্মান করার অন্তর্ভুক্ত।
এমন হাদিসের আলোকে যদি ভাবি, তাহলে বোঝা যায়—আলেমদের গালি দেওয়া কেবল একটি ‘মত’ নয়, এটা দ্বীনকে আহত করা।
আলেমদের অবমাননার ঐতিহাসিক পরিণতি
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—যেখানে আলেমদের হেয় করা হয়েছে, সেখানকার সমাজ ঈমানহীনতা ও চারিত্রিক অবক্ষয়ে ধ্বংস হয়েছে। আন্দালুসের পতন, উপমহাদেশে মুসলিম সমাজের পিছিয়ে পড়া—সবক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, আলেম ও দ্বীনের শিক্ষকের সম্মান নষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতিও পথ হারিয়েছে।
আমাদের করণীয়
১. মতভেদ থাকলে তা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে শিখি।
২. কোনো আলেম ভুল করলে সে বিষয়ে প্রমাণ ও আদব রেখে পরামর্শ দিই।
৩. সামাজিক মাধ্যমে গালি নয়—দুআ করি, যেন আল্লাহ তাঁকে সংশোধনের তাওফিক দেন।
৪. আমাদের সন্তানদের শেখাই, আলেমদের সম্মান করতে হয়—এমনকি যদি মতভেদও থাকে।
আলেমদের সম্মান করা মানে দ্বীনের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা। আলেমদের গালি দেওয়া মানে নিজের আত্মা, জাতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঘৃণার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া। সমাজে আলো ছড়াতে চাইলে, প্রথমেই আমাদের সেই আলোর বাহকদের সম্মান করতে হবে।
আসুন, আমরা আলেমদের নিয়ে ঠাট্টা না করে তাঁদের থেকে দীন শিখি, তাদের ভুল হলে দোয়া ও ভদ্রতায় তার সমাধান খুঁজি। গালি নয়, গঠনমূলক মত প্রকাশই হোক আমাদের অভ্যাস।
লেখক: বদরুল ইসলাম
সাংবাদিক, বরগুনা।