মামলা একজনের, জেল খাটছেন অন্যজন। লোভের বশবর্তী হয়ে, অনেকটা জেনেশুনে। মাসাধিককাল ধরে জেলের ঘানি টানছেন এক নারী ও এক পুরুষ। তারা হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার ছোট কুড়িপাইকা গ্রামের রিকশাচালক সেলিম মিয়া এবং নুরপুর গ্রামের কাউসার মিয়ার স্ত্রী হাজেরা বেগম।
ছোটকুড়ি পাইকা গ্রামের হাসেনা বেগমের স্বামী সেলিম মিয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয় ছিল মাদক মামলার আসামি হান্নান মোল্লার। পূর্বপরিচয়ের সূত্রে তার বাড়িতে এসে একটি মাদক মামলায় বদলি হাজিরা দিতে বলেন তাকে। বিনিময়ে একটি রিকশা কিনে দেবেন সেলিম মিয়াকে। রাজি হন সেলিম মিয়া। ঘটনার দিন ১১ মার্চ তার বাড়িতে এসে স্ত্রীর কাছে ৫শ’ টাকা গুঁজে দেন হান্নান মোল্লা। তারপর মোটরসাইকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিয়ে যান তাকে। ওইদিনই উপস্থিত হয়ে সেলিম নিজেকে হান্নান মোল্লা বলে পরিচয় দিয়ে হাজিরা দেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। আদালত তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মামলায় জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠান। পরিবারের সদস্যরা বলেন, সেলিমকে ৫-৭ দিন কারাগারে থাকতে হবে বলে জানিয়েছিলেন হান্নান। জামিন বাতিল হলে কারাগারে পাঠানোর ৭-৮ দিন পেরিয়ে গেলেও জামিন না পেয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন তিনি। ২৩ মার্চ জেল সুপার কারাগার পরিদর্শনকালে ঘটনাটি অবহিত হয়ে ২৪ মার্চ সংশ্নিষ্ট আদালতে তা জানান।
সেলিমের স্ত্রী হাসেনা বেগম জানান, হান্নান আমার স্বামীকে নিয়ে যাওয়ার আগে আমার হাতে ৫শ’ টাকা গুঁজে দেয়। বলে- রিকশা চালাতে হবে না, রিকশা কিনে দেবে সে। তারপর মোটরসাইকেলে করে নিয়ে যাওয়ার পর আর কোনো খোঁজ পাইনি। ৫-৭ দিন পর কারাগার থেকে ফোন আসে- আমার স্বামী জেলে। তিনি বলেন, আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে উপবাস থাকছি। আমার স্বামীকে এনে দিন। তার বৃদ্ধ বাবা আবুল ফয়েজ বলেন, আমার ছেলেকে পটিয়ে নিয়ে জেলে দিয়েছে। আমি তার মুক্তি এবং হান্নান মোল্লার বিচার দাবি করছি।
অন্যদিকে অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসায় আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়ে হাজেরা বেগমকে (স্বামী কাউসার মিয়া, গ্রাম নূরপুর, আখাউড়া) শোভা বেগম নামে এক মাদক মামলার আসামির হাজির দিতে বলেন মামলার আইনজীবী দোলন আরা। হাজেরার এক ছেলে ও মেয়ে রয়েছে। আইনজীবীর কথায় সায় দেন তিনি। গত ৬ মার্চ শোভা বেগমের মাদক মামলায় আদালতে উপস্থিত হন তিনি নিজেকে শোভা বেগম (৪০) নামে পরিচয় দেন। আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করে প্রেরণ করেন কারাগারে।
হাজেরার মেয়ে হালিমা বলে, ‘আমার মা-ই সব কিছু। সংসার চালানো ও বাবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করার কথা বলে উকিল আপা বাড়ি থেকে নিয়ে যায় আমার মাকে। আমরা প্রথমে মনে করেছিলাম মা বোধহয় বাবার চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে না পেরে ও আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে না পেরে বাড়ি থেকে চলে গেছে। কিন্তু পরে খবর পাই- উকিল এ কাজ করেছে। এখন আমরা মানুষের বাড়ি থেকে চেয়ে চেয়ে ভাত খাচ্ছি।’
স্থানীয়রা জানায়, আর্থিক দুরবস্থার সুযোগে স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীর কুদৃষ্টি পড়ে পরিবার দুটির ওপর। সামান্য টাকার লোভে অন্যের মামলায় আদালতে উপস্থিত হয়ে স্বীকারোক্তি দেওয়ায় কারাগারে বন্দি জীবনযাপন করছে তারা।
এদিকে, হাজিরা বদল নিয়ে তোলপাড় চলছে জেলাজুড়ে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর আদালত সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আদালতের আদেশের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানায় মাদক মামলার আসামি হান্নান মোল্লা ও কারাগারে দুই বন্দির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। সেইসঙ্গে মামলার আইনজীবী দোলন আরাকে শোকজ করেছেন আদালত। পুলিশ জানিয়েছে, প্রকৃত আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। থানায় মামলা হয়েছে এ নিয়ে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট এস এম ইউসুফ বলেন, ‘মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া শুরুর আগেই আইন বহির্ভূত এমন কর্মকাণ্ড ঘটেছে। ঘটনাটি ন্যক্কারজনক।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মিজানুর রহমান পিপিএম বলেন, ‘প্রকৃত আসামিদের গ্রেফতার অভিযানের পাশাপাশি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। মাদক মামলার আসামি হান্নান মোল্লা ঘটনার পর ভারতে পালিয়ে গেছে। আমরা তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছি। সত্য গোপন করে আদালতে উপস্থিত হওয়ায় মামলা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও।’
মাদক মামলার আইনজীবী দোলন আরা বেগমের বক্তব্য নিতে তার বাড়ি গিয়েও পাওয়া যায়নি তাকে