আহমাদুল্লাহ আশরাফঃ
বড় হয়েছি বটে, কিন্তু হারিয়ে যাওয়া শৈশব কৈশরের আনন্দমাখা দিনগুলো আজ বড্ড বেশী মনে পড়ে। সেই ছেলে মানুষি আজও মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে পড়ে। শৈশবে বাউন্ডুলে না হলেও নিজেরমত করে উল্লাসে মেতে থাকতাম, পেয়েছিলাম ইচ্ছামত জীবনও। যতদিন গ্রামে ছিলাম কষ্ট, ব্যথা বলতে কিছু আছে তা চোখে পড়েনি। ভাবতাম পৃথিবীর সব শিশুরাই আমার মতো হৈ-হুল্লোড় জীবন কাটায় অথবা নিশ্চিন্তে বাবা-মায়ের আঁচলে স্নেহের নীড় বাঁধে। কিন্তু মুদ্রার ওপিঠে নির্মম বাস্তবতা এত তিক্ততার সাথে দেখতে হবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি।
সম্ভবত ২০০৯ সালের শেষ দিকের কথা, সেবার প্রথম ঢাকায় আসি। সেই ছোটবেলা থেকেই রাজধানী শহর নিয়ে বেশ কৌতূহলী ছিলাম। আর কৌতূহলী মন নিয়ে ঠিক যখন লঞ্চ থেকে সদর ঘাটে পা রাখবো এমনসময় কিছু বাচ্চাদের চেঁচামেচি শুনতে পাই, প্রথমে ভেবেছিলাম লঞ্চ ঘাটে ভিড়েছে বলে বাচ্চারা আনন্দ করছে। কিন্তু যেই ওদের দিকে তাকালাম,নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। কতগুলো অর্ধলোঙ্গ শিশু এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে।পরক্ষনেই আবার সবাই সংঘবদ্ধ হয়ে খালি বোতল কুড়াচ্ছে, আবার কেউ সদ্য ভেড়ানো লঞ্চ থেকে বেশবড় বড় বস্তা টেনে চলেছে। অথচ তখনও দিনের আলো ফুটে ওঠতে পারেনি। হয়ত খাওয়া দাওয়াও হয়নি, রাজ্যের যত বিষণ্ণতা ফুটে উঠেছে কোমলমতি শিশুদের চেহারায়। উষ্কখুষ্ক চুলগুলো,বোতামহীন অর্ধ তালিযুক্ত টি-শার্ট, কেউ আবার নগ্ন দেহে।

শরীর বলতে কঙ্কাসাঁরক্ষয়িস্নতা, কারো হাতে মুখে ছড়িয়ে আছে ক্ষতের চিহ্ন। এরা কারা? কী ওদের পরিচয়? ওরা কি মানুষ নয়? হাজার প্রশ্নের ধাঁরা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। মামাকে জিজ্ঞেস করলাম- ওরা কারা? মামা বললেন- ওরা সদরঘাটের টোকাই। -ওদের কোনো বাবা-মা নেই? -থাকলেও জানা নেই। কী আজব ব্যাপার! ওরা মানুষ হলেও কতো নিঃস্ব। কতো অসহায়। ওরা টোকাই বলে স্বাভাবিক জীবনযাপনের কোনো অধিকার নেই ওদের? ওদের ভবিষ্যৎ কী হবে? কেমন হবে ওদের আগামী কর্মময় জীবন? নিজের শিশুসুলভ মনে প্রশ্নো জাগে ওরাও তো আমার মতই শিশু, তাহলে বাবা-মা’র আদর স্নেহের পরিবর্তেএভাবে বোতল কুড়িয়ে জীবন বাঁচাতে হচ্ছে কেন?ওদের ওতো আমাদের মতই জীবনে ভালোবাসার দাবী আছে, মায়ের আদুরে হাতের নীচে মাথা রেখে ঘুমানোর অধিকার রয়েছে। অথচ সেই আদিম কালের মত বর্বর জীবন যুদ্ধে নিজের অস্তিত্বকে জানান দেবার জন্য বেঘোরে খেটে খাচ্ছে ওরা! দিনভর পানি, বাদাম,ভুট্টা, ফুটপাতে বিক্রি করছে।রোদে পুড়ে, পানিতে ভিজে দিনাতিপাত করছে। আর রাত নামলেই বিড়াল-কুকুরের পাশে দূর্গন্ধময় আবর্জনার স্তুপে বস্তা আবৃত হয়ে কাটিয়ে রাত্রি যাপন করছে! মুদ্রার ওপিঠে কেউ এয়ারকন্ডিশন গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ নরম জাজিমে রাত যাপন করছেআবার কেউ বা মজার মজার খাবার খেয়ে দিব্বি সুখেই আছে। অথচ এই পথ শিশুগুলি অনিশ্চয়তায় ধুকে মরছে। নানা রকম ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে আছে। সরকার আবার শিশু অধিকারের নামে নানা কর্মসুচি ঘোষণা করছে। কথায় কথায় “শিশু অধিকার বাস্তবায়ন করো!” কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে যার আছে তাকে আরো দাও, আর যাদের কিছুই নেই তাদের মরতে দাও। এসব বুভুক্ষুদের দেখার জন্য কেউ কি আর দাঁড়াবে না? নিশ্চিত কি করবে না শিশু অধিকার?